বাংলাদেশ এখনও এশিয়ার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে। এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দেশের নারীরা।
গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৫’-এ জানানো হয়েছে, দেশে ২৬ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে পুরুষের হার ৪২ শতাংশ। মূল বাধা হিসেবে উঠে এসেছে ক্রয়ক্ষমতা, সাক্ষরতা ও ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি।

জরিপে ১৫টি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ। ২০২৪ সালে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্মার্টফোনের মালিকানায়ও বড় ধরনের লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ পুরুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যেখানে নারীদের হার মাত্র ২৫ শতাংশ।
মুঠোফোন মালিকানাতেও চিত্র ভিন্ন নয়। পুরুষদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের মুঠোফোন আছে, অথচ নারীদের মধ্যে এই হার ৬৮ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই ব্যবধান পাকিস্তানের পরেই সবচেয়ে বেশি।
তবে আশার কথা হলো, গত পাঁচ বছরে দেশে মুঠোফোন মালিকানায় লিঙ্গবৈষম্য ৪ শতাংশ এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে ২ শতাংশ কমেছে।
জিএসএমএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো ফিচার ফোন বা বাটন ফোন ব্যবহার করেন। এটি বিশেষ করে রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। যদিও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ফোনের ব্যবহার ইতিবাচক। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ পুরুষ ও ৭৩ শতাংশ নারী ব্যবসায়িক কাজে মুঠোফোন ব্যবহার করেন।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞ ও ডিনেট ও আই-সোশ্যালের প্রধান নির্বাহী অনন্য রায়হান জানান, সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতায় ঘাটতি।
জিএসএমএ বলেছে, বাংলাদেশসহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের বড় বাধা হলো ক্রয়ক্ষমতা। পাশাপাশি সাক্ষরতার অভাব, ইন্টারনেট ডেটার উচ্চমূল্য, প্রাসঙ্গিক কনটেন্টের ঘাটতি ও নিরাপত্তাশঙ্কাও উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশ পুরুষ ও ৭৮ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট সম্পর্কে জানেন। কিন্তু তাঁদের প্রায় অর্ধেকই তা ব্যবহার করেন না। জিএসএমএ-এর মতে, বাংলাদেশ এই বিষয়ে ভারত থেকেও পিছিয়ে।
গ্রামীণ নারীরা প্রযুক্তিগতভাবে বেশি বঞ্চিত। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৫৪ শতাংশ গ্রামীণ নারী ইন্টারনেট সম্পর্কে জানেন, কিন্তু ব্যবহার করতে পারেন না। নারী ও পুরুষ—দুজনেই ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন পড়তে-লিখতে না পারা, স্মার্টফোন ও ডেটা কেনার সামর্থ্যের অভাব এবং নিরাপত্তাশঙ্কা।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ৩০ শতাংশ নারী ও ১৭ শতাংশ পুরুষ পড়তে ও লিখতে না পারায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না। ২০ শতাংশ পুরুষ ও ১৬ শতাংশ নারী ডেটার খরচকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে ধীরগতির ইন্টারনেটও ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমানে দেশের মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাপ্তাহিক ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজগুলো হলো—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো, ভিডিও দেখা, মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার, ভিডিও কল করা ও অনলাইন বিনোদন। কিন্তু কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরির খোঁজ, সরকারি সেবা কিংবা অনলাইনে আয় করার মতো বিষয়গুলোতে আগ্রহ ও ব্যবহার অনেক কম।
ডিজিটাল প্রযুক্তির অর্থবহ ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনন্য রায়হান পরামর্শ দিয়েছেন, সহজলভ্য ও প্রয়োজনীয় কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। ডিজিটাল প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে এবং বাজারের বিদ্যমান উদ্যোগগুলো কতটা কার্যকর, তা নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে।
তাঁর মতে, সরকার যদি কিস্তিতে স্মার্টফোন কেনার সুযোগ চালু করে এবং ডেটার খরচ কমাতে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন করে, তবে এই ব্যবধান অনেকটাই কমে আসবে। একই সঙ্গে কর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা পুনর্বিবেচনা করে গ্রাহকবান্ধব মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে নারী-পুরুষের এই ব্যবধান কমিয়ে আনা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং একটি সমাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। এজন্য সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
4o