মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব

News Desk

মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব. Dhakainlight.com

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার আগে দেশের অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে করনীতিতে পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়েছে। আগামী ২ জুন ২০২৫ তারিখে বাজেট ঘোষণার সময় সরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ, জনগণবান্ধব এবং কার্যকর আয়কর কাঠামো উপস্থাপন করবে—এমনটাই আশা করা হচ্ছে। স্নেহাশীষ বড়ুয়া তাঁর বিশ্লেষণে ব্যক্তিগত ও করপোরেট খাতসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ করসংক্রান্ত প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং সাধারণ জনগণের ওপর চাপও হ্রাস পাবে।

বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জটিল ও সংকটপূর্ণ। রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতির উচ্চ প্রবণতা, বৈদেশিক ঋণের চাপ, কর্মসংস্থানের অভাব এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস—সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন এক কঠিন পরীক্ষার মুখে। এই প্রেক্ষাপটে আয়কর কাঠামো ঢেলে সাজানো একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

মূল প্রস্তাবনাগুলো নিম্নরূপ:

১. ব্যক্তিগত আয়কর সীমা পুনর্নির্ধারণ:
বর্তমানে ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চলমান মূল্যস্ফীতি এবং বাস্তব আয় কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এই সীমা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা উচিত বলে মত দিয়েছেন স্নেহাশীষ বড়ুয়া। তিনি প্রবীণ নাগরিক ও নারীদের জন্য এই সীমা ৫ লাখ টাকা করার সুপারিশ করেছেন। এতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন। পাশাপাশি প্রথম স্তরের কর হার ১ লাখ টাকার পরিবর্তে ৩ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

২. করপোরেট কর হার ও নগদ লেনদেন:
বর্তমানে করপোরেট কর হ্রাসের জন্য নগদ লেনদেন সীমা বছরে ৩৬ লাখ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে এই সীমা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োগযোগ্য। তাই এটি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে: প্রথম বছরে ২০ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ১৫ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ১০ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরে ৫ শতাংশ। এতে করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার আওতায় আসবে এবং কর ফাঁকির সুযোগ কমবে।

৩. উৎস কর কর্তন হার:
বর্তমানে উৎসে কর কর্তনের হার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বেশি, যা প্রকৃত লাভের তুলনায় অতিরিক্ত কর আদায় করে থাকে। এর ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়ে এবং ভোক্তাদের ওপর চাপ পড়ে। এই হারগুলোর বাস্তব ভিত্তিতে জরিপ চালিয়ে তা পুনর্নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

৪. অগ্রিম আয়কর:
আমদানি করা কাঁচামালের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর ধাপে ধাপে কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে করে উৎপাদন খরচ কমবে এবং শিল্প খাত কিছুটা স্বস্তি পাবে।

৫. অনাবাসী আয়ের ওপর উৎস কর:
বর্তমানে অনাবাসী ব্যক্তিদের ওপর ২০-৩০ শতাংশ হারে উৎস কর আরোপ করা হয়, যা দ্বৈত করের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এই হার ১০-১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। হংকং ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী প্রযুক্তিগত ফি’র ওপর কম হার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই নজির অনুসরণ করে অন্যান্য দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিতেও একই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

৬. প্রচারণামূলক ব্যয়:
বর্তমানে বিক্রির ০.৫% পর্যন্ত প্রোমোশনাল ব্যয় অনুমোদিত হলেও এটি অনেক ব্যবসার বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। শিল্পভেদে প্রচারণামূলক ব্যয় সীমা পুনঃনির্ধারণ ও বিনা মূল্যে নমুনা সরবরাহের সীমা শিল্পভিত্তিক করে নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে।

৭. উৎস কর কর্তনে ব্যর্থতার জন্য জরিমানা:
সরবরাহকারীদের প্রয়োজনীয় দলিল না থাকলে ৫০% বেশি কর কাটা হয়। তবে একই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও খরচ অযোগ্য ঘোষণার বিধানটি অনৈতিক ও অযৌক্তিক। এটি বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছে।

৮. ন্যূনতম বিকল্প কর (MAT):
ন্যূনতম কর ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে MAT ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব এসেছে। এতে কোনো কোম্পানি MAT পরিশোধ করলে তা ১৫ বছর পর্যন্ত পরবর্তী করের বিপরীতে সমন্বয় করার সুযোগ থাকবে। অনেক উন্নত দেশ ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু করেছে।

৯. আয়কর আইনের বাস্তবায়ন পদ্ধতি:
বর্তমানে অনেক আয়কর বিধান ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর হয়, যা ব্যবসা পরিচালনায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। তাই আগামী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ভবিষ্যত ভিত্তিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সংক্ষেপে, স্নেহাশীষ বড়ুয়ার প্রস্তাবনা ব্যক্তি করদাতা, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সহনশীল ও বাস্তবমুখী কর কাঠামো গড়ে তোলার রূপরেখা দিয়েছে। এই কাঠামো গ্রহণ করলে অর্থনীতি ত্রাণ পাবে, রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

লেখক: স্নেহাশীষ বড়ুয়া, অংশীদার, স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি।

Leave a Comment

Footer Section