বাংলাদেশের পল্লী বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত জটিলতার মুখোমুখি নয়। এরপরও গত দুই দশক ধরে সংস্কারের বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়ে আছে, যা প্রশাসনিক জড়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ‘লক-ইন’ পরিস্থিতির এক বাস্তব উদাহরণ।
ঢাকা শহরের রাস্তায় এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে, দাবি-দাওয়া জানাতে। এই দৃশ্য এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে অনেকে আর গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এই দাবিগুলোর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের অব্যবস্থা, যাকে বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ‘লক-ইন’। এটি এমন এক অবস্থান, যেখানে প্রতিষ্ঠান বা খাতগুলো এমনভাবে গেঁথে গেছে পুরনো নিয়ম-কানুন ও চর্চায়, যে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাধাগ্রস্ত হয়।
১৯৭৭ সালে ইউএসএআইডি ও এনআরইসিএ-এর সহায়তায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) গঠিত হয়। বর্তমানে এর অধীন রয়েছে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, যারা দেশের ১৪ কোটি গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৫৭ শতাংশ আসে পল্লী বিদ্যুৎ থেকে। শিল্প, কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত গত ২০ বছরেও কাঠামোগত কোনো সংস্কার দেখতে পায়নি।
২০২০ সালের এক কর্মশালায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি না থাকলেও পল্লী এলাকায় ৬৮ শতাংশ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে নিম্নমানের মালামালের কারণে। আরইবি সারা দেশে একক নকশা ব্যবহার করে, যেখানে ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের বৈচিত্র্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যেমন, পঞ্চগড় ও বরিশালে একরকম বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তা কখনো যাচাই করা হয়নি।
সমস্যার আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো মালামাল কিনে আরইবি থেকেই, কিন্তু তার মান নিরীক্ষার ব্যবস্থা কার্যত নেই। সব ধরনের নীতিমালা, বদলি, পদোন্নতি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি আরইবির হাতে। কোনো সমস্যা হলে তদন্ত করে আরইবিই, আর শাস্তি হয় সমিতির কর্মীদের। এই একতরফা নিয়ন্ত্রণে দায়দায়িত্বের ভারসাম্য নেই।
২০২৪ সালে আন্দোলনরত কর্মীদের মাধ্যমে এই অনিয়মগুলো প্রথম বড় পরিসরে সামনে আসে। তারা অভিযোগ করেন, ঝড়-বৃষ্টিতে বারবার লাইনের সমস্যা হলে জনগণের কাছে অপমানিত হতে হয়। আবার কর্মীদের নিরাপত্তা নেই—দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও নেই ক্ষতিপূরণ।
এমন এক বাস্তবতায়, গত অক্টোবরে কিছু সময়ের জন্য প্রতীকী বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে প্রতিবাদ করেন কর্মীরা। ১৭ জন গ্রেপ্তার হন, যাঁদের অনেকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। এর আগে একই ভাষা প্রয়োগ হয়েছিল হাসিনা সরকারের আমলেও—যা রাজনৈতিক রং দিয়ে তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে দমন করার একটি কৌশল।
সরকার ২০২৪ সালের অক্টোবরে পল্লী বিদ্যুৎ কাঠামো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে, যেটি ফেব্রুয়ারিতে প্রেজেন্টেশনও দেয়। এতে তিনটি সংস্কার মডেল তুলে ধরা হয়—একীভূতকরণ ছিল সেগুলোর একটি। কিন্তু আরইবি এখনও মতামত দেয়নি, ফলে প্রতিবেদনের প্রকাশ বিলম্বিত হচ্ছে। মার্চে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিদ্যুৎ বিভাগকে একীভূতকরণ বাস্তবায়নের চিঠি দিলেও তা বিদ্যুৎ বিভাগ ফেরত পাঠায়—যা সরকারের দ্বিমুখী অবস্থানকে স্পষ্ট করে।
২০০৫ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট সংস্কারের পক্ষে সুপারিশ দিয়েছে। এনআরইসিএ, বিদ্যুৎ বিভাগ, এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও একীভূত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামোর পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি।
পল্লী বিদ্যুৎ কর্মীদের অভিযোগের কেন্দ্রে এখন রয়েছে নির্বিচারে বদলি। লাইনম্যানরা দীর্ঘদিন এক এলাকায় কাজ করার ফলে সে এলাকার প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটি, রাস্তাঘাট, মিটার চেনেন। নতুন জায়গায় বদলি হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে এবং ফলে পরিষেবা বিঘ্নিত হয়। ২০২৫ সালের মে মাসে দেখা যায়, এক মাসে আড়াই হাজারের বেশি কর্মীকে বরখাস্ত, স্ট্যান্ড রিলিজ বা বদলি করা হয়েছে—এর মধ্যে এমনকি একজন মৃত ব্যক্তির নামেও বদলির চিঠি গেছে।
২৭ মে থেকে দেশজুড়ে কর্মবিরতি পালন করছেন কর্মীরা। তাঁদের দাবি একটাই—চেয়ারম্যান অপসারণ, হয়রানি বন্ধ এবং চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল।
২০২৪ সালে ইউএসএআইডির একটি গবেষণায় বলা হয়, আরইবি পদোন্নতি ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে সমিতিগুলোকে কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সমিতিগুলো এবার সাহস করে মুখ খুলছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারে ২০ বছর পার হয়ে যাওয়া এক প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা।
সরকার এখন অন্তর্বর্তীকালীন, যার প্রধান দায়িত্বই হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করা। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ খাতে তারা কতটা আন্তরিক, সেই প্রশ্ন এখন দিন দিন জোরালো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রতা যে কতটা ভোগান্তির কারণ হতে পারে, তারই প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে পল্লী বিদ্যুতের সংস্কার।