ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত, যার মধ্যে ৭৪০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি)। এই রেখা শুধু ভৌগোলিক বিভাজন নয়, বরং দুই দেশের মধ্যকার টানটান উত্তেজনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে বসবাস করা মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক নিত্যসঙ্গী। সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলার পর সীমান্তজুড়ে আবার শুরু হয়েছে গোলাবর্ষণ। ভারতের অংশে অন্তত ১৬ জন নিহত এবং পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী তাদের এলাকায় ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিশ্চিত নয়।
পাকিস্তানি লেখক আনাম জাকারিয়া, যিনি কানাডায় বসবাস করেন এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর নিয়ে গবেষণা করেছেন, বিবিসিকে বলেন, এলওসির পাশে বসবাসরত পরিবারগুলো দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও উত্তেজনার বলি হয়। গোলাগুলির সময় মানুষ বাংকারে আশ্রয় নেয়, গবাদিপশু ও জীবিকা ধ্বংস হয়। হাসপাতাল, ঘরবাড়ি ও স্কুল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই সীমান্তটি প্রথম বিশ্বে পরিচিত হয় ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান প্রথম যুদ্ধে। ১৯৪৯ সালে এটি ‘সিজফায়ার লাইন’ নামে চিহ্নিত হয়। ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এর নামকরণ হয় ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’। কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই রেখা দুই দেশের ভূখণ্ডকে স্পষ্টভাবে ভাগ করে দিয়েছে।
যদিও দুই দেশই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ দাবি করে, বাস্তবে তারা কাশ্মীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এলওসি তাই পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সামরিকীকৃত সীমান্তে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যতই হোক, তা থাকে ক্ষণস্থায়ী—পরবর্তী উত্তেজনা আসা মাত্রই তা ভঙ্গ হয়।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, এলওসিতে হালকা গোলাগুলি থেকে শুরু করে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়। ভূমি দখল, কৌশলগত চূড়াগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রচেষ্টা—এসবই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের চেহারা নেয়।
আনাম জাকারিয়ার মতে, এই রেখা দুই দেশ টেনেছে নিজেদের মতো করে, কাশ্মীরিদের মতামতের তোয়াক্কা না করে। এটি রক্তে রঞ্জিত ও সংঘাতে গড়া এক সীমান্ত। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মোতায়েন, অস্ত্র ও গোলাবারুদের আধিক্য এলওসিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
এই ধরনের যুদ্ধকালীন সীমান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক সুমন্ত্র বোস জানান, এ রকম আরেকটি সুপরিচিত সীমান্ত হলো ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরের মধ্যকার ১৯৪৯ সালের ‘গ্রিন লাইন’।
২০২১ সালে ভারত ও পাকিস্তান একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছিল। চার বছর সীমান্ত অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকলেও, সাম্প্রতিক হামলার পর পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
কার্নেগি ইন্ডিয়ার বিশ্লেষক সূর্য ভালিয়াপ্পান কৃষ্ণ বলেন, ২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে ২০১৭ সালের শুরু পর্যন্ত সময়ে সীমান্তে বড় ধরনের সংঘাত ও গুলিবিনিময়ের কারণে ২৭ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।
পেহেলগামে হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে। পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়। অথচ এই সিমলা চুক্তিই নিয়ন্ত্রণরেখাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল।
জ্যাকব মনে করেন, দুই দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় বরাবরই এলওসিতে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। অথচ বাস্তবে এই লঙ্ঘন সামরিক ও বেসামরিক উভয় দিকেই ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
তার গবেষণায় বলা হয়েছে, সীমান্তে ব্যবহৃত হয় ১০৫ মিমি মর্টার, ১৩০ ও ১৫৫ মিমি আর্টিলারি গান, এমনকি ট্যাংকবিধ্বংসী গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত। এসব অস্ত্র বেসামরিকদের ওপরও আঘাত হানে।
হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল নয়, বরং তা মাঠপর্যায়ের সামরিক বাস্তবতা থেকে উৎসারিত হয়। অনেক সময় স্থানীয় কমান্ডাররাই বৈরিতার সূচনা করেন—কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়াও।
এই বাস্তবতা বোঝা জরুরি। কারণ, যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের দায় শুধু পাকিস্তানের ওপর চাপানো হলেও তা একতরফা নয়। ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। দুই পক্ষের সীমান্ত বাহিনীগুলোর হাতে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন থাকা, প্রতিক্রিয়া দেখানোর নিয়ম—সব মিলিয়ে সীমান্তকে অস্থির করে রাখে।
কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, নিয়ন্ত্রণরেখাকে একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সীমান্তে পরিণত করা নিয়ে যে ধারণা আগে উঠেছিল, সেটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে অনেকেই বলেন, সেটি কখনোই বাস্তবসম্মত ছিল না।
অধ্যাপক সুমন্ত্র বোস বলেন, পাকিস্তান যদি নিয়ন্ত্রণরেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে তা হবে ভারতের শর্তে কাশ্মীর ইস্যুর নিষ্পত্তি। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন কোনো সরকার এই অবস্থান নেয়নি।
তার মতে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এলওসিকে একটি মানবিক ‘সফট বর্ডার’-এ রূপান্তর করার মধ্য দিয়েই আসতে পারে—যা শত্রুভাবাপন্ন সীমানার পরিবর্তে সহনশীল সীমান্ত হবে।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এমন প্রস্তাবও ছিল ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনার কেন্দ্রে। তবে সেই প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে।
বর্তমানে সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, আর সীমান্তবাসীর জন্য তা পুনরায় বয়ে এনেছে সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা।
পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এক হোটেল কর্মচারী বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণরেখার দিকে মুখ করে আজ রাতে কেউই ঘুমাতে চায় না।’
এই বক্তব্য মনে করিয়ে দেয়—যখন জানালার ওপারে যুদ্ধক্ষেত্র, তখন শান্তি কেবলই এক ভঙ্গুর প্রতিশ্রুতি।