পরিবারের অভাব মোচনের আশায় বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন শরীয়তপুরের আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেন। গন্তব্য ছিল ইতালি। কিন্তু স্বপ্নযাত্রা রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে। দালাল চক্রের প্রতারণায় পড়ে লিবিয়ায় গিয়ে দু’বার বন্দি হন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন এবং পরিবার থেকে মোট ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। সব হারিয়ে অবশেষে তাঁরা ৭ মে দেশে ফেরেন, কিন্তু ততক্ষণে পরিবার নিঃস্ব।
আহসান উল্লাহ ও আলতাফ হোসেন, দুজনেরই বয়স ৩০ বছর। তাঁরা শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মনুয়া গ্রামের বাসিন্দা। কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া এই দুই তরুণ স্থানীয়ভাবে কৃষিকাজ করেই জীবিকা চালাতেন। পড়ালেখা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটাতে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় এক দালাল হারুন লস্করের মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকা চুক্তিতে তাঁরা ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন ২০২৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর।
তাঁদের প্রথমে নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কায়, সেখানে ২৪ দিন থাকার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হয়ে পৌঁছান লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে। সেখান থেকে ১৬ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু যাত্রা শুরু হওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যেই লিবিয়া পুলিশ তাঁদের আটক করে। পরে চুক্তিবদ্ধ দালাল তাঁদের ছাড়িয়ে নেয় এবং জাওয়াইয়া নামের এক জায়গায় আটকে রাখে। সেখানে তাঁদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন।
পুনরায় ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি তাঁদের সমুদ্রপথে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। এবারও একইভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আটক হন তাঁরা। আবারো নির্যাতন, আবারো ভিডিও কলে পরিবারের সামনে নির্যাতনের দৃশ্য দেখিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে দালাল চক্র। পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে জমি বন্ধক রেখে, জমি বিক্রি করে এবং ঋণ করে চার দফায় মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করেন।
আহসান উল্লাহর পরিবার ৪৯ লাখ টাকা এবং আলতাফ হোসেনের পরিবার ৬৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেয় দালালদের কাছে। এ ছাড়া পূর্বের চুক্তির ১৬ লাখ টাকা তো রয়েছেই। এভাবে মোট ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আহসান বলেন, “স্বপ্ন ছিল পরিবারের মুখে হাসি ফোটাব, বাস্তবে হয়ে গেল ঠিক উল্টো। এখন শুধু ঋণের বোঝা আর কষ্টের স্মৃতি।”
আলতাফ হোসেন বলেন, “দুবার সমুদ্রপথে যাওয়ার নামে আমাদের ফাঁদে ফেলে নির্যাতন চালানো হয়। চরম অবমাননাকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। পরিবারকে নিঃস্ব করে আজ শুধু জীবনটাই নিয়ে দেশে ফিরেছি।”
তাঁদের বিদেশ যাত্রার দায়িত্বে ছিলেন ভেদরগঞ্জের হারুন লস্কর। আহসান উল্লাহর পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছে। হারুন দাবি করেন, তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন, দালাল চক্রের বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা নেই।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, “এই অঞ্চলের অনেকেই ইউরোপে যেতে চান, সেই সুযোগে কিছু মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। আমরা এই বিষয়ে একাধিক মামলা নিয়ে কাজ করছি। যাঁরা দালালির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ভেদরগঞ্জের ঘটনাটি আমরা তদন্ত করব।”
এই ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কতটা ভয়াবহ হতে পারে দালাল চক্রের প্রতারণা। বিদেশে যাওয়ার আগে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং প্রতারকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। দেশ ছাড়ার আগে সচেতন না হলে, একটি স্বপ্নের যাত্রা যেমন দুটি পরিবারকে নিঃস্ব করতে পারে, তেমনি একটি সমাজকেও করতে পারে বিপর্যস্ত।