প্রকৃতির বিচিত্রতা মাঝে মাঝে এমন কিছু উপহার দেয়, যা সময়ের সঙ্গে হয়ে ওঠে আর্থিক সম্ভাবনার উৎস। ঠিক তেমনই এক বিস্ময়—আগরগাছ। এ গাছের শরীর জুড়ে পোকা ও ছত্রাকের আক্রমণে তৈরি হয় এক বিশেষ রজন পদার্থ, যার নির্যাস থেকে উৎপন্ন হয় বিশ্বজুড়ে আরাধ্য এক সুগন্ধি—আতর। আর এই আতরের ঘ্রাণ এখন পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজপ্রাসাদেও।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন আগরগাছের চাষ হচ্ছে। ছায়াঘেরা পাহাড়, আর্দ্র মাটি, আর প্রাকৃতিকভাবে সহায়ক পরিবেশ—সব মিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে উঠেছে আগরচাষের অনন্য উপযোগী স্থান। আগরগাছের কাঠে যখন পোকা বা ছত্রাক আক্রমণ করে, তখন গাছ নিজেকে রক্ষা করতে এক ধরনের রজন তৈরি করে। সেই রজন জমে গাঢ় রঙ ধারণ করে এবং কেটে নিলে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত সুগন্ধি। এই কাঠই কোটি টাকার পণ্য হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বাজারে।
তবে আজকের বাণিজ্যিক আগরচাষ কেবল প্রকৃতির দয়ায় দাঁড়িয়ে নেই। চাষিরা আগরগাছে কৃত্রিমভাবে পেরেক ঢুকিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেন। সেই ক্ষতস্থানে ছত্রাকের আক্রমণে জমতে থাকে সুগন্ধিজাত রজন। এভাবেই গাছ পরিণত হয় মূল্যবান আতরের উৎসে। একেকটি পরিপক্ব গাছ বিক্রি হয় লাখ লাখ টাকায়।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার উগলছড়ি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনন্ত সিং চাকমা ৩৬টি আগরগাছ বিক্রি করে আয় করেছেন ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে একটি গাছের দাম ছিল ৬ লাখ টাকা। একই উপজেলার আলোময় চাকমা তিনটি গাছ বিক্রি করেছেন প্রায় ৩ লাখ টাকায়। বাঘাইছড়ি ও খেদারমারা ইউনিয়নের তালুকদার পাড়া, তুলাবান, ঢেবাছড়ি, মহিষপয্যা, শিজক, নলবনিয়া—এমন বহু গ্রামের বাসিন্দারা আজ আগরচাষে জীবনধারার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছেন।
সুগন্ধি তৈরির চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে বাঘাইছড়ির তালুকদার পাড়া ও তুলাবান গ্রামে। সেখানে কাঠ কেটে পানিতে ভিজিয়ে, তারপর আগুনে সেদ্ধ করে পাতনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় আতর। এই আতর রপ্তানি হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। সেখানে এটি ‘লাক্সারি প্রোডাক্ট’ হিসেবে ব্যাপক চাহিদা পায়। সিলেটের আগর ব্যবসায়ী মো. আবদুল আলিম জানিয়েছেন, “বাংলাদেশ থেকে যেটুকু রপ্তানি হয়, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম।”
প্রকৃতিগতভাবে উৎপন্ন আতর সবচেয়ে মূল্যবান। তবে সব গাছ সুগন্ধি তৈরি করতে পারে না। অনেক গাছ শুধু কাঠের নির্যাস থেকে অল্প মানের সুগন্ধি দেয়, যেগুলোর বাজারমূল্য তুলনামূলক কম। পেরেক দিয়ে প্রক্রিয়াজাত গাছের প্রতি তোলা আতরের দাম যেখানে প্রায় ৬ হাজার টাকা, সেখানে প্রাকৃতিক আতরের দাম তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
২০০৯ সালে বন বিভাগ ৫০০ একর জমিতে আগরচাষ শুরু করে। ১৯৯৬ সালে রোপণকৃত কিছু বাগান থেকে এখন আগর সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সেই সময় কাচালং আর্যপুর বনবিহারে রোপণ করা হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার আগর চারা। বর্তমানে বাঘাইছড়িতে ব্যক্তি মালিকানাধীন আগরগাছের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তবে এই সম্ভাবনার মাঝেও রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। এখনো আগর ব্যবসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে ও অগঠিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাই কোনো কেন্দ্রীয় হিসাব বা রপ্তানি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ২০২৩ সালে রাঙামাটিতে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। এটি রেজিস্ট্রেশন পেলে স্থানীয় উৎপাদকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও সংগঠিত বাজার ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলার প্রতিটি গ্রামের ছোট বড় আগরবাগান এখন শুধুই সৌন্দর্যের অংশ নয়—সেখানে লুকিয়ে রয়েছে এক নতুন অর্থনৈতিক মুক্তির গল্প। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য এটি হয়ে উঠছে জীবিকার নির্ভরযোগ্য উৎস। নতুন করে সুগন্ধি কারখানা স্থাপন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও বৈজ্ঞানিক সহায়তা পেলে এই খাত হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের রপ্তানি আয়ের নতুন দিগন্ত।
আতরের সুবাস পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মরুর বুকে। এই সুগন্ধি শুধু একটি পণ্যের ঘ্রাণ নয়, এটি এক সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর জীবনঘনিষ্ঠ সফলতা—যার গল্প বলা দরকার আরও বড় করে, আরও বহু জায়গায়।