গরু-মহিষ ও ভেড়া-ছাগলের খুরারোগের টিকা কেনায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, একই কোম্পানির কাছ থেকে একই পরিমাণ টিকা কিনতে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বেশি ব্যয় করছে অধিদপ্তর।
টিকা সরবরাহে প্রথমে কম দর দিয়েও কাজ পায়নি ওএমসি লিমিটেড। পরে প্রায় দুই মাস পর, আগের তুলনায় বেশি দর প্রস্তাব দিলে সেই প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয় সরকার। অথচ, সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল অন্য প্রতিষ্ঠান জেনটেক, যাদের প্রস্তাব ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রভাবশালী চাপের অভিযোগ
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর দপ্তরে এসেছিলেন, তবে টিকার বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, ওএমসিকে কাজ পাইয়ে দিতে ওই ব্যক্তির প্রভাব ছিল।
তবে অধিদপ্তর দাবি করছে, টিকা নিরাপদ কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্প পরিচালক অমর জ্যোতি চাকমা বলেন, “সর্বনিম্ন দরদাতার টিকায় গর্ভপাত ও পশু মৃত্যুর ঝুঁকি আছে।” কিন্তু সেই দাবি প্রমাণসাপেক্ষ এবং পূর্ববর্তী সরবরাহ ইতিহাসে জেনটেকের টিকায় তেমন অভিযোগ ছিল না।
দরপত্রের বিবরণ
খুরারোগ (FMD) নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে টিকা কেনার জন্য মোট তিনবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।
- প্রথম দফায় অংশ নেয়নি ওএমসি।
- দ্বিতীয় দফায় ওএমসি টিকা সরবরাহ করতে চায় ৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকায়, কিন্তু কাজ পায়নি।
- তৃতীয় দফায় একই পরিমাণ টিকা সরবরাহের জন্য ৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয় এবং এবার কাজ পায় ওএমসি।
এই দফায় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল জেনটেক, যাদের প্রস্তাব ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা কম।
প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য
অমর জ্যোতি চাকমা বলেন, “তৃতীয় দফায় কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে।” তবে কী শর্ত শিথিল করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা ‘মুখস্থ করে রাখেননি’ বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, “ওএমসির টিকা নিরাপদ, আর জেনটেকের টিকায় গর্ভপাতের ঝুঁকি আছে।” যদিও আগের সময়েও জেনটেকের টিকা ব্যবহার করা হয়েছিল।
মূল্য কমাতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি অধিদপ্তর
ওএমসি যখন আগের চেয়ে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বেশি দর প্রস্তাব দেয়, তখন সেই বাড়তি দর নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বরং অধিদপ্তর সরাসরি তাদের কাজ দিয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু সুফিয়ান বলেন, “কারিগরি বিবেচনায় ওএমসির টিকা ভালো মনে হয়েছে। আর্থিক দিক ছাড়াও এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
ওএমসি লিমিটেডের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি
রাজধানীর পান্থপথে ওএমসির অফিসে ৪ মে গিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। এমনকি ই-মেইলের মাধ্যমেও কোনো জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
দুদকের অভিযান
এই ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর গত ২৪ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অভিযান চালায়। তারা প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর ঘুরে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে।
দুদক জানিয়েছে, তাদের পরবর্তী কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “এই প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সন্দেহের জায়গা আছে। এখানে রাষ্ট্রের অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে—এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।”
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করা।”