সরকার একটি নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করেছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হলো রাজস্ব প্রশাসনকে আরও আধুনিক, দক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক করা। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মূলত নীতি নির্ধারণ ও রাজস্ব আদায়ের কাজ পৃথক করা হলো, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সহ অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের পরামর্শ।
রাজস্ব নীতি বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হবে এবং এর প্রধান কাজ হবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায় একটি যুক্তিসঙ্গত, বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই বিভাগ আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস, সম্পদ কর, দান কর, ভ্রমণ কর, স্ট্যাম্প শুল্কসহ যাবতীয় রাজস্ব সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি ও সংস্কারের দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া স্ট্যাম্প আইন ও অন্যান্য কর আইন প্রণয়ন বা সংশোধন, কর মওকুফ বা ছাড়ের বিধান নির্ধারণ এবং রাজস্ব আহরণের বর্তমান চিত্র বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করাও এর দায়িত্বের মধ্যে থাকবে।
এই বিভাগের আওতায় কাস্টমস বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি এবং রাজস্ব সংশ্লিষ্ট বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদনের মতামত প্রদান করা হবে। কর আইন প্রয়োগ এবং কার্যকারিতার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব কাঠামোকে বাস্তবভিত্তিকভাবে উন্নত করার কাজ করবে এই বিভাগ। নীতিমালার বাস্তবায়ন ও উন্নয়নে সহায়তার জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে থাকবে অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, আইনজীবী, হিসাব ও নিরীক্ষা বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষের সদস্যরা।

এই বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে রাজস্ব, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা, আইন ও ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের। সরকার চাইলে অন্য যেকোনো উপযুক্ত কর্মকর্তা বা ব্যক্তিকে সচিব পদে নিয়োগ দিতে পারবে।
অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ মূলত কর আহরণ এবং নীতির বাস্তবায়নের কাজ করবে। এই বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ, করসেবা কার্যক্রম পরিচালনা, করজাল সম্প্রসারণে উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং সবাইকে কর কাঠামোর আওতায় আনতে কার্যক্রম গ্রহণ করবে। কাস্টমস ও দ্বৈত কর পরিহার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, করসেবা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন এবং নীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করবে।
এই বিভাগে দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা, নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এনবিআরের বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই বিভাগে স্থানান্তর করা হবে। প্রয়োজন অনুসারে কিছু কর্মকর্তা রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করা যাবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে তার জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এই কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে করনীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে পরিষ্কার বিভাজন তৈরি হয়েছে। পূর্বে এনবিআর নীতি তৈরি এবং বাস্তবায়ন—দুই কাজই করত, ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ঘাটতি ছিল। এখন নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব একদিকে এবং রাজস্ব আদায়ের বাস্তবায়ন অন্যদিকে থাকায় প্রত্যেক বিভাগের কার্যক্ষমতা আলাদাভাবে পরিমাপ করা যাবে এবং একে অপরের উপর নির্ভর না করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে তারা কাজ করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের ফলে রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, পাশাপাশি বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গতিশীলতা আসবে। জনসাধারণের আস্থাও বাড়বে, কারণ করনীতি ও করআহরণের ক্ষেত্রে এখন থেকে পৃথক জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বাড়াতে, ব্যবসা সহজ করতে এবং উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য স্থায়ী অর্থের উৎস নিশ্চিত করতেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
4o