ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, পাকিস্তানের দাবি করা আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির বেশিরভাগই ভুয়া এবং ভিত্তিহীন। ১০ মে ২০২৫, শনিবার সকালে নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই বার্তা দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং এবং কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। তারা জানান, পাকিস্তানের আগ্রাসনের জবাবে ভারত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে এবং তাতে পাকিস্তানের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ভারত জানায়, পাকিস্তান প্রথমে হামলা চালায় শুক্রবার রাত ১টা ৪০ মিনিট নাগাদ, যখন পশ্চিম সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিতে একযোগে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালানো হয়। এসব আক্রমণের লক্ষ্য ছিল উধমপুর, ভাটিন্ডা, ভূজ ও পাঠানকোটের ঘাঁটিগুলো। কর্নেল সোফিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, মোট ২৬টি স্থানে হামলার চেষ্টা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রতিহত করা হয়েছে। কিছু সীমিত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আদমপুর, ভাটিন্ডা ও উধমপুরে।
ভারত আরও দাবি করে, পাকিস্তান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেসামরিক এলাকা ও ধর্মীয় স্থাপনাতেও আঘাত হেনেছে। শ্রীনগর, অবন্তিপুরা, উধমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হাসপাতাল ও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। রাজৌরি জেলায় অতিরিক্ত জেলা উন্নয়ন কমিশনার রাজ কুমার থাপাসহ আরও দুইজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালানোর অভিযোগ তোলেন। তার ভাষায়, পাকিস্তান ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা রাজস্থানের সুরতগড় ও হরিয়ানার সিরসার বিমানঘাঁটি গুড়িয়ে দিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, এমনকি আদমপুরে ভারতীয় এস–৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব দাবিকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো জনসচেতনতা বিভ্রান্ত করতে পাকিস্তানের অপচেষ্টা।
এই দাবিগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের সামনে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে উল্লেখ করা ঘাঁটিগুলোর সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরে। সেখানে দেখা যায়, এসব স্থাপনায় কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
পাশাপাশি ভারতের পাল্টা হামলার ভিডিওও প্রদর্শন করা হয়, যেখানে পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি—নূর খান, মুরিদ, শোরকোট, রফিকি, চাকওয়ালা, সুক্কুর, চুনিয়া, পসরুর ও শিয়ালকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়। প্রতিটি হামলায় বেসামরিক প্রাণহানী এড়াতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ।
ভারত সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে এবং উসকানিমূলক আচরণের মাধ্যমে বড় ধরনের সংঘাতে জড়ানোর চেষ্টা করছে। ভারতের পক্ষ থেকে আবারও জানানো হয়, দেশটির নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং সেনাবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।
পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে ভারত স্পষ্ট করেছে, এই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ছিল কৌশলগত, প্রয়োজনীয় এবং আত্মরক্ষামূলক। ভারতের তরফ থেকে দেওয়া তথ্য, উপস্থাপন করা ছবি ও ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে তারা বোঝাতে চেয়েছে, পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ভুয়া প্রচার চালিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ ও সমর্থন আদায় করতে চাইছে।
এই উত্তেজনা কেবল সামরিক সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি বৃহৎ কূটনৈতিক ও তথ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান দুই পক্ষই প্রচারমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে। তবে সঠিক তথ্য ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি উঠছে দুই দেশেই।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজ, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদি কূটনৈতিক চাপ ও আলোচনা শুরু না হয়, তাহলে এই দ্বন্দ্ব যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তার ফল হবে ভয়াবহ।
এই মুহূর্তে ভারত জোরালোভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জানিয়ে দিচ্ছে যে তারা যুদ্ধ চায় না, কিন্তু সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য। পাকিস্তানের চালানো মিথ্যা প্রচার এবং প্রতিনিয়ত যুদ্ধ উস্কানিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংকট এখন দুই দেশের নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার বড় এক পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।