: সংকটে বাংলাদেশি রপ্তানি খাত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর অজুহাতে আবারও বিশ্বব্যাপী শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছেন। এবার তার লক্ষ্য মূলত উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো, যাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। সেই তালিকায় আছে বাংলাদেশও। গত ২ এপ্রিল তিনি ঘোষণা দেন, ৫৭টি দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ রেসিপ্রোকাল (পাল্টা) শুল্ক আরোপ করা হবে। যদিও পরে কিছুটা পিছু হটে তিন মাসের জন্য তা স্থগিত করা হয়, কিন্তু কার্যকর করা হয়েছে ন্যূনতম হার। এরই মধ্যে এর কড়া প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর।
কী ঘটছে বাস্তবে?
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের প্রায় ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। যুক্তরাষ্ট্রে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য, যা দেশের মোট রপ্তানির ১৭ শতাংশ। এই বাজারে কাজ করে ২,৩২৬টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান।
তবে বর্তমানে মার্কিন ক্রেতারা নতুন করে রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। বড় ক্রেতারা শুল্কের অর্ধেক (৫%) এবং ছোটো ক্রেতারা পুরো ১০% পর্যন্ত ছাড় দাবি করছেন। এর ফলে রপ্তানিকারকেরা পণ্যের FOB (Free on Board) মূল্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছেন—যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যত মুনাফাহীন বা লোকসানে রপ্তানি করছে।
স্প্যারো গ্রুপের অভিজ্ঞতা
দেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যার অর্ধেকের বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি শোভন ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁরা ইতোমধ্যে FOB মূল্যের ওপর ৫% ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, “শুল্ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এটি চলতেই থাকবে।”
প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের বাস্তবতা
৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার রপ্তানি করা প্যাসিফিক জিনস জানাচ্ছে, তাদের রপ্তানির ২৫% যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ক্রেতা ভেদে কখনো ৫%, কখনো ১০% ছাড় দিতে হচ্ছে। এর ফলে রপ্তানিতে কোনো মুনাফা থাকছে না।
সাময়িক স্বস্তি, কিন্তু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে
শুল্ক কার্যকরের পর ঢাকার উইকিটেক্স-বিডি নামের একটি বায়িং হাউসের তিন লাখ ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়েছিল। তবে শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় আবার সেই পণ্য জাহাজীকরণের নির্দেশ আসে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও এ কে এম সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, “চীন থেকে অনেক মার্কিন অর্ডার বাংলাদেশে আসছে, তবে নতুন ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা সীমিত। আলোচনা চলছে, তবে অস্থিরতা এখনও কাটেনি।”
একই ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়েছে এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টস। তারা ইউরোপীয় বাজারের দিকে ঝুঁকছে, কারণ মার্কিন বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
রপ্তানি বাড়লেও আস্থার সংকট
তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৭%। চীন ও ভিয়েতনামকেও পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির মাঝেও ব্যবসায়ীদের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে শুল্কব্যবস্থার অনিশ্চয়তার কারণে।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতির মন্তব্য
মাহমুদ হাসান খান বলেন, “মার্কিন ক্রেতারা জানতে চাইছে, এই শুল্ক যদি বহাল থাকে, আমরা কতটুকু অংশ বহন করব? এ বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট নীতিনির্ধারণ জরুরি।”
সারসংক্ষেপ
- ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ৫–১০% মূল্য ছাড় দিতে হচ্ছে।
- ইতোমধ্যে মুনাফা কমে এসেছে বা শূন্যে নেমেছে বহু প্রতিষ্ঠানে।
- চীন থেকে মার্কিন অর্ডার স্থানান্তর হচ্ছে, তবে নতুন মার্কিন ক্রেতারা অনিশ্চিত।
- যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু শুল্ক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে জটিল করছে।
- প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশনা ও মার্কিন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা।