৯২ বছরেও থামেনি সাইকেলের চাকা

News Desk

৯২ বছরেও থামেনি সাইকেলের চাকা. Dhakainlight.com

: জীবন এখনো ছুটে চলে আনোয়ার হোসেনের প্যাডেলে ভর করে

নাটোরের সিংড়া উপজেলার ধুলাউড়ি গ্রামের সরু মেঠোপথে প্রতিদিনই দেখা মেলে এক বৃদ্ধের, যিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে আজও অটুট। নাম আনোয়ার হোসেন। বয়স ৯২ বছর ১০ মাস। কিন্তু কেউ যদি তার সাইকেল চালানোর গতি দেখে, চোখ বন্ধ করে বয়স অনুমান করতে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি বিভ্রান্ত হবেন। কারণ বয়স এখানে কেবল সংখ্যা—জীবনচর্চায় আনোয়ার হোসেন এখনো এক উদ্যমী তরুণের মতো।

তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া বয়স্ক ভাতার কার্ড—দুটোতেই জন্ম তারিখ লেখা ৫ জুলাই, ১৯৩২। মানে এখনো তিনি শতবর্ষ ছোঁয়ার দোরগোড়ায়। অথচ সাইকেল চালিয়ে তিনি পেরিয়ে যান গ্রামের গলি, হাটবাজার, এমনকি জেলার সীমাও। তাঁর গল্প যেন জীবন্ত এক ইতিহাস; যেখানে বয়স, কষ্ট কিংবা একাকীত্ব—কোনো কিছুই থামিয়ে দিতে পারেনি তাঁর চলার গতি।

আনোয়ার হোসেনের শরীর জীর্ণ, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে—সোজা হয়ে দাঁড়ানোও কষ্টকর। কিন্তু তাতে কী? প্রতিদিন সকালে উঠেই তিনি নিজের সাইকেলটি ভালোভাবে ঝাড়ামোছা করেন, চেক করেন চেইন, ব্রেক, প্যাডেল। তারপর তিনি রওনা হন। কোথায় যাবেন, সেটি নির্ভর করে মনের ইচ্ছের ওপর। কেউ ডাকলে, কিছু প্রয়োজন হলে, কখনো স্রেফ নিজের আনন্দেই, তিনি সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলেন।

পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, আনোয়ার হোসেন সারাদিনে খান শুধু গুড়-মুড়ি। মাঝে মাঝে কেউ হয়তো ভাত বা রুটি দেয়, তবে সেটিও তাঁর ইচ্ছায় গ্রহণ করেন। রান্নার ঝামেলা পছন্দ করেন না। দিনগুলো তাঁর কাটে মিতব্যয়ী, অথচ আত্মমর্যাদাপূর্ণভাবে।

তাঁর একমাত্র ছেলে লিটন হোসেন বর্তমানে গ্রামেরই একজন ভ্যানচালক। লিটন বলেন, “বাবা নিজে নিজে সব কাজ করেন। বাকি মানুষ হয়তো বয়স হলে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, কিন্তু তিনি নন। কোনো কাজেই আমাদের সহযোগিতা নিতে চান না। ছোটখাটো অসুস্থ হলেও ওষুধ খেয়ে নিজেই উঠে পড়েন।”

আনোয়ার হোসেনের দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে। সাধারণত মানুষ এমন বয়সে গৃহকোণে থাকতেই পছন্দ করে, কিন্তু আনোয়ার হোসেন বরাবরই ব্যতিক্রম। বছরে অন্তত দু’বার, কখনো আরো বেশি—তিনি ধুলাউড়ি থেকে পাঁচবিবি পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে মেয়েদের দেখতে যান। পরিবার থেকে কেউই প্রথমে সেটা মানতে চাইত না। ভয় পেতো। কিন্তু আজ সবাই জেনে গেছেন—তাঁকে থামানো যায় না।

শুধু জয়পুরহাট নয়, বগুড়ায় থাকা ভাইয়ের বাড়িতেও তিনি যান নিয়মিত। বাস বা ট্রেন আছে, জানেন তিনি। তবুও সাইকেল চালিয়ে যেতেই তাঁর শান্তি। বড় মেয়ে লোপা বেগম বলেন, “বাবা বাসে গেলে শরীরের ওপর কম চাপ পড়ত, কিন্তু উনি বলেন—গাড়িতে বসে বসে সময় নষ্ট হয়, সাইকেল চালিয়ে গেলে মন ফুরফুরে থাকে।”

আনোয়ার হোসেনের জীবন যেন এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। তাঁর ছোট্ট টিনের ঘরটি ছিমছাম করে সাজানো। দেয়ালে টানানো পুরোনো রেডিও, আর পাশে সাইকেল মেরামতের টুলবক্স। সেখানে সময় যেন দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান আমলে। আনোয়ার হোসেন জানান, তাঁর জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। বাবা পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে পরিবার করাচিতেই থাকত। দেশভাগের পর চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে, শুরু হয় নতুন অধ্যায়।

পড়ালেখা না হলেও তাঁর জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বিস্ময়কর। বাবার কাছ থেকে কিছু ইংরেজি শেখা দিয়েই পরে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ট্রাক চালকের চাকরি পান। কর্মজীবনে কখনো বাস চালিয়েছেন, কখনো ট্রাক। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন—সেসব গল্প আজো তাঁর মুখে জীবন্ত।

প্রথম স্ত্রী মারা যান পাকিস্তান আমলে। তারপর স্বাধীনতার দু’বছর পর ধুলাউড়ি গ্রামে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই স্ত্রীও এখন প্রয়াত। সন্তান, আত্মীয়, প্রতিবেশী—সবার ভালোবাসা থাকলেও তাঁর সঙ্গী এখন একটাই—সাইকেল।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, “এত বয়সে কষ্ট হয় না?” উত্তরে আনোয়ার হোসেন শুধু হাসেন। বলেন, “চলতে থাকলে শরীর থামে না। আর থেমে গেলেই মরার আগে মরে যাই।” তাঁর এই চিন্তাধারা আজকের সমাজের তরুণদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা।

সত্যিই, ৯২ বছর বয়সে জীবন যেখানে অনেকের কাছে থেমে যাওয়া গল্প, সেখানে আনোয়ার হোসেনের প্রতিদিন নতুন করে শুরু হওয়া একটি অধ্যায়।

Leave a Comment

Footer Section