দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপের উপকূলে এক বিশেষ এবং জনপ্রিয় নারী সম্প্রদায় বাস করে, যাদের নাম হ্যানইও (Haenyeo)। এই মহিলারা সারা বছর ধরে সাগরে ডুব দিয়ে সামুদ্রিক প্রাণী যেমন সি আর্চিন, অ্যাবালোন, এবং অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্য সংগ্রহ করেন। তারা প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সাগরের পানির নিচে থেকে ১৮ মিটার (৬০ ফুট) পর্যন্ত গভীরতায় ডুব দিয়ে কাজ করেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই মহিলারা কোনো অক্সিজেন সাপ্লাই বা ডুবুরি যন্ত্র ছাড়া, শুধুমাত্র একটি ওয়েটস্যুট পরে এসব কাজ করেন।
গবেষকরা জানাতে চেয়েছিলেন, হ্যানইওরা কীভাবে এই অসাধারণ শারীরিক কার্যকলাপ পরিচালনা করেন এবং তাদের শরীরে বিশেষ কোনো জিনগত পরিবর্তন রয়েছে কি, যা তাদের দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেন ছাড়াই ডুব দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। সম্প্রতি, ২ মে, ২০২৫ তারিখে সেল রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই বিষয়ে নতুন এক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা হ্যানইওদের শরীরের বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে, যা তাদের মুক্ত ডুব দেওয়ার শারীরিক চাপ সহ্য করতে সাহায্য করে।
এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন মেলিসা আন্ন ইলার্ডো, যিনি ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। গবেষণার অংশ হিসেবে, তিনি দক্ষিণ কোরিয়া, ডেনমার্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীদের সাথে মিলে, ৩০ জন হ্যানইও ডুবুরি, ৩০ জন ডুব না করা মহিল এবং ৩১ জন দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ভূখণ্ডের মহিলা থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন এবং তাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেন। গবেষকরা এছাড়া, অংশগ্রহণকারীদের হার্ট রেট, রক্তচাপ এবং স্প্লীন সাইজ পরিমাপ করেছিলেন।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে, যে মহিলারা জেজু দ্বীপের বাসিন্দা, তারা মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ কোরিয়ার মহিলাদের তুলনায় চার গুণ বেশি সম্ভবত এমন একটি জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট ধারণ করেন যা তাদের রক্তচাপ কম রাখতে সাহায্য করে। এই বৈশিষ্ট্য তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে কারণ হ্যানইওরা গর্ভাবস্থাতেও ডুব দিয়ে থাকেন, যখন উচ্চ রক্তচাপ শিশুর জন্য বিপদজনক হতে পারে।
গবেষকরা আরও দেখতে পান যে, জেজু দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে আরেকটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে যা ঠাণ্ডা এবং ব্যথা সহ্য করার সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। তবে, এই বৈশিষ্ট্যটি তারা নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করতে পারেননি, কারণ তারা অংশগ্রহণকারীদের ঠাণ্ডা সহ্য করার ক্ষমতা পরিমাপ করেননি।
এছাড়াও, গবেষণায় এটি দেখা গেছে যে, হ্যানইও ডুবুরিরা আরও ধীর হার্ট রেট নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন, যা তাদের অক্সিজেন সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে। হ্যানইওদের হৃদস্পন্দন মূল ভূখণ্ডের মহিলাদের তুলনায় ৫০% বেশি কমে যায় ডুব দেওয়ার সময়। এটি সম্ভবত তাদের প্রশিক্ষণের ফল, কারণ এটি শুধুমাত্র হ্যানইওদের মধ্যেই দেখা গেছে।
গবেষকরা এই তথ্য দিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন, যা ভবিষ্যতে রক্তচাপের সমস্যার চিকিৎসায় নতুন পথ খুলে দিতে পারে। আর গবেষকরা আশা করছেন যে, এই জেনেটিক বৈশিষ্ট্যগুলি আরও বিস্তারিতভাবে গবেষণা করা হবে, যা রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সম্পর্কিত নতুন ঔষধ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।
এই গবেষণাটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কীভাবে প্রাচীন, শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং জীবনযাপন, মানব শরীরে বিবর্তনের মাধ্যমে বিশেষ শারীরিক ক্ষমতার সৃষ্টি করতে পারে।