মঙ্গলবার মধ্যরাত পার হয়ে বুধবার ভোরে পাকিস্তানে ভারতের সর্বশেষ বিমান হামলা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন অন্ধকার অধ্যায় হয়ে উঠেছে। যদিও হামলাটি দুঃখজনক, তবে বিস্ময়কর নয়। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় জনমনে যে যুদ্ধ-উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তাতে এই হামলা অনুমেয় ছিল।
ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপি এই হামলার মাধ্যমে যুদ্ধপিপাসু জনগণের আবেগ কিছুটা মেটাতে পেরেছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দাও তুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই হামলা কি সত্যিই ভারতকে নিরাপদ করেছে? যুদ্ধ শুরু করা সহজ হলেও তা থামানো অত্যন্ত কঠিন। ইতিহাস বারবার সেই কথাই বলে।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের ঘাটতি ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
পেহেলগামের হামলায় বিশ্বব্যাপী নিন্দা এলেও, ভারত এখনো পর্যন্ত এই ঘটনার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে পাকিস্তানকে দায়ী করার প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সমর্থন মেলেনি বললেই চলে। এমনকি ভারতীয় মিত্র রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়াও এই ঘটনায় পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে দায়ী করেনি।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে ৬ মে’র বিমান হামলা অনেকের কাছেই ‘প্রতিশোধ’ নয়, বরং ‘আগ্রাসন’ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। পাঞ্জাব ও আজাদ কাশ্মীরে নিহত সাধারণ মানুষদের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার বলেও অনেকে অভিমত দিচ্ছেন।
দারিদ্র্যপীড়িত মানুষই মূল বলি
ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশের সীমান্তে কিংবা সীমান্তের ভেতরে যারা মরবে বা আহত হবে, তারা মূলত দরিদ্র মানুষ। এদের কেউ থাকবে উর্দি পরা সৈনিক, কেউ থাকবে সাধারণ নাগরিক। মিডিয়ায় তাদের নিয়ে আবেগঘন গল্প তৈরি হবে, অথচ এই ফাঁকে সামরিক বাজেট বেড়ে যাবে, বাণিজ্যিক অস্ত্র বিক্রি তুঙ্গে উঠবে, এবং ধর্মীয়-জাতিগত উত্তেজনা সমাজজুড়ে আরো জেঁকে বসবে।
এই যুদ্ধের সরাসরি কোনো স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান-শিখদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষ বাড়বে। পাকিস্তানে স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতের ক্ষেত্রেও এমন পদক্ষেপ আসতে দেরি নেই।
মোদি-শাহ জুটির কৌশল ও আরএসএসের পরিকল্পনা
আগামী বছর আরএসএসের শতবর্ষ। এই সংগঠনের একমাত্র রাজনৈতিক এজেন্ডা হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা। বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণ করেও উত্তর প্রদেশে প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় বিজেপি এখন নতুন রণকৌশল বেছে নিয়েছে—যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদ।
এই মুহূর্তে বিজেপি-আরএসএস জুটি দেশজুড়ে মতাদর্শিকভাবে চ্যালেঞ্জহীন। বিরোধী দলগুলো এমনকি কংগ্রেসও সরকারি হামলার পক্ষে আগাম সমর্থন জানিয়েছে, মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ফলে, বিরোধীদের কার্যত আত্মসমর্পণ যুদ্ধমুখী রাজনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
মিডিয়া এবং সাধারণ মনস্তত্ত্বে সন্ত্রাসের ছাপ
ভারতের প্রায় সব মিডিয়া পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসীদের দেশ’ হিসেবে চিত্রিত করছে। পুরো জাতিকে সন্ত্রাসের ছায়ায় ফেলা এক বিপজ্জনক প্রবণতা, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
যদি বিজেপি এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আগাম নির্বাচন ডাকে এবং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করে, তাহলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা
এই যুদ্ধ ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়াবে। একদিকে মার্কিন শুল্কনীতি, অন্যদিকে যুদ্ধ—দুটো মিলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিজস্ব অর্থনৈতিক জোট গঠনের সম্ভাবনা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
ট্রাম্প প্রশাসন ও ইসরায়েল গাজায় নিজেদের কার্যকলাপ থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিতে চাইছিল—ভারত তাদের সেই সুযোগটা করে দিল।
বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর পরিস্থিতি
এই যুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশেও লাগবে। ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশই চায় বাংলাদেশ তাদের পাশে থাকুক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হলো, এখানে একটি নির্বাচিত সরকার নেই, নেই কার্যকর পার্লামেন্ট।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের যেকোনো প্রতিক্রিয়াও ভারত-পাকিস্তান আলাদা দৃষ্টিতে নেবে। তার ওপর ভারতের মিডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চলছে, যা এখন এই যুদ্ধ-উত্তেজনার সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলাদেশের উচিত হবে এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। মিয়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডরের আলোচনা স্থগিত রাখা এবং সীমান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি রাখা।
শেষ কথা
এই যুদ্ধ যেমন রাজনৈতিক কৌশল, তেমনি বিপদের আলামত। দক্ষিণ এশিয়ায় দক্ষিণপন্থার জয়যাত্রা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করে না, এটা সমাজের ভিত নাড়িয়ে দেয়, দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে, জাতিগত বিভাজনকে বাড়ায়। এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না—হারবে কেবল সাধারণ মানুষ।