চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। শেষ হয়েছে আসলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ইংল্যান্ডের জন্য। বাকি পাঁচ দলের সবার জন্যই টুর্নামেন্টটা এখনো জীবন্ত।
ওদিকে গতকালই বাংলাদেশ দল ফিরে গেছে দেশে। নিজেদের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আপাতত শেষ ফিল সিমন্স অধ্যায়ও। তিনি ফিরে গেছেন নিজ দেশে। তবে এই শেষ থেকেও হতে পারে নতুন শুরু।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বিদায় করার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ক্রিকেটার সিমন্সকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য জাতীয় দলের কোচ নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি। সে দায়িত্ব শেষ হলেও বেতন–ভাতা ও অন্যান্য শর্তে মিললে তিনি হয়তো এবার দীর্ঘ মেয়াদেই বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব নেবেন।
এই ছয় মাসের ‘ট্রায়াল পিরিয়ডে’ বিসিবি সিমন্সকে দেখেছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। কোচ হিসেবে ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়দের সঙ্গে আচরণ এবং স্থানীয় কোচদের সঙ্গে রেখে শেখানোর আগ্রহ—এসবই ছিল তাঁর মধ্যে এবং এই প্রতিটি মানবিক বিষয়ে সিমন্স ভালোভাবে পাসও করে গেছেন। এখন শুধু চুক্তির শর্তে বনলেই আগামী দুই–আড়াই বছরের জন্য বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পেয়ে যাবেন তিনি। অবশ্য একজন কোচ হিসেবে বিসিবির দৃষ্টিতে সিমন্স ‘খুব ভালো নন, আবার খুব খারাপও নন।’
সিমন্সকে লম্বা সময়ের জন্য রাখার চিন্তার মূল কারণ, তিনি স্থানীয় কোচদের কাজ করার স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত। তাঁর সঙ্গে কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন স্থানীয় কোচরা। বিসিবির পরিকল্পনা, সিমন্সের মতো একজন বিদেশিকে প্রধান কোচ রেখে জাতীয় দলের সহকারী কোচদের সারিতে স্থানীয় কোচদের আরও প্রাধান্য দেওয়া। সিনিয়র সহকারী কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেছেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। এই পদে তাঁর দায়িত্বের মেয়াদ আরও বাড়ছে বলেই জানা গেছে।
শুধু তা–ই নয়, সিমন্সের সঙ্গে সহসা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সারা না গেলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আসন্ন তিন ওয়ানেড ও তিন টি–টোয়েন্টির হোম সিরিজে সালাউদ্দিনই থাকবেন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের ভূমিকায়। ব্যাটিং–বোলিং কোচ হিসেবেও ভবিষ্যতে স্থানীয় কোচদের জাতীয় দলের সঙ্গে নেওয়ার পরিকল্পনা বোর্ডের। বিসিবি মনে করে, তাদের এই পরিকল্পনার সঙ্গে দারুণ মানানসই হবেন সিমন্স।
মজার ব্যাপার হলো, ফারুক আহমেদের বোর্ড এবার একজন মানবিক কোচ খুঁজলেও ২০১৯ সালের পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের দুজন বিদেশি কোচ ‘অতি মানবিক’ হয়ে উল্টো বিপদে পড়েছিলেন।
২০১৯ বিশ্বকাপের মাঝপথে তো বিদায়ই নিতে হয় ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসকে। ড্রেসিংরুমে নাকি তাঁর যথাযথ ‘কমান্ড’ ছিল না। আরেকজন দক্ষিণ আফ্রিকান রাসেল ডমিঙ্গো অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিজেই চাকরি ছেড়েছেন, এ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না বলে। পদত্যাগ না করলে বিসিবিই তৈরি ছিল তাঁকে বিদায় করতে। ডমিঙ্গোর বিরুদ্ধেও ছিল একই অভিযোগ—তিনি ক্রিকেটারদের কোনো কিছুর জন্য চাপ দিতেন না। দিয়ে দিয়েছিলেন অতিরিক্ত স্বাধীনতা।
একজন কড়া হেডমাস্টার খুঁজতে খুঁজতে সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের বোর্ড এরপর ফিরিয়ে আনে সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে। অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারেরও মত ছিল তাতে, যদিও শেষ দিকে তাঁদেরই কারও কারও বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন হাথুরুসিংহে। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কান এই কোচ চাকরি হারান জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারকে ‘শারীরিকভাবে লাঞ্চিত’ করার অভিযোগে।
রোডস, ডমিঙ্গো, হাথুরুসিংহে এবং মাঝে পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন—বাংলাদেশ দল থেকে প্রত্যেকেরই বিদায়ের পেছনে কাজ করেছে ক্রিকেটারদের কারও কারও কাছে তাঁদের অপ্রিয় হয়ে ওঠা। এই ক্রিকেটাররাই কাউকে বলেছেন অতি কোমল, কাউকে বলেছেন অতি কঠোর। নাজমুল হাসানের বোর্ডও বারবার কোচ পরিবর্তনের সময় দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে। যে কারণে এটাই কখনো স্পষ্ট করে বোঝা যায়নি যে বাংলাদেশের আসলে কেমন কোচ চাই—মানবিক কোচ, নাকি কড়া হেডমাস্টার?
বিসিবিতে সিমন্সের চাকরি লম্বা সময়ের জন্য হলে সেটা হবে মানবিক কোচ হিসেবেই। ড্রেসিংরুমে তাঁর সুনাম, তিনি খুব কড়া করে কথা বলেন না। বললেও যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই বলেন। এই ছয় মাসে দলের কারও প্রতি ব্যক্তিগত রাগ–অনুরাগ দেখা যায়নি তাঁর মধ্যে।
সিমন্সের সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দলের সঙ্গে যখন যে স্থানীয় কোচ কাজ করেন, তাঁকে তিনি কাজ করার পর্যাপ্ত সুযোগ দেন। বিসিবির চাওয়াও এটাই, বিদেশি প্রধান কোচের সঙ্গে থেকে যেন বাংলাদেশের কোচরা নিজেদের টেস্ট দলের দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে পারেন। অবশ্য ভবিষ্যতে এই কোচদের যোগ্যতাও কোমলতা এবং কঠোরতা দিয়ে বিবেচনা করা হবে কি না, সেটা পরের ব্যাপার।