২০২৫ সালের মে মাস। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের বার্ষিক সভায় হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর ভিড়। সবার দৃষ্টি মঞ্চে বসে থাকা সেই কিংবদন্তি মানুষটির দিকে—ওরেন বাফেট। ৯৪ বছর বয়সেও তিনি সুস্থ, প্রাণবন্ত এবং স্বাভাবিকভাবেই হাসিখুশি। কিন্তু এদিন তাঁর কণ্ঠে ছিল এক ভিন্ন ধরণের আবেগ। দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের নেতৃত্ব দিয়ে যিনি একে পরিণত করেছেন পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী কনগ্লোমারেটে, সেই ওরেন বাফেট এবার তাঁর চেয়ারে ইতি টানলেন।
তিনি নিজেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলেন—“এটাই সময়। নেতৃত্বের ভার এখন গ্রেগ অ্যাবেলের হাতে তুলে দেওয়ার উপযুক্ত মুহূর্ত।” মুহূর্তের মধ্যে হলঘরে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতা। এই একটি ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হলো এক যুগ, আর শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।
ওরেন বাফেট শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আদর্শ, একটি দর্শন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারীরা তাঁর বিনিয়োগের স্টাইল, সহজ-সরল জীবনের আদর্শ এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর ‘ভ্যালু ইনভেস্টিং’ নীতিমালা আজ বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগ শিক্ষা ও কৌশলের অংশ।
ছোট্ট এক টেক্সাস শহর থেকে উঠে আসা এই মানুষটি Wall Street-এ নিজস্ব ছাপ রেখেছেন শুধু টাকার কারণে নয়, বরং সততা, স্বচ্ছতা এবং দৃঢ়নৈতিক বিশ্বাসের জন্য। তিনি কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ বা অস্পষ্ট ব্যবসায় পা রাখেননি, বরং এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন যাদের পণ্য, পরিষেবা এবং ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য।
তবে সময় তো থেমে থাকে না। বয়সের ভারে নয়, বরং সময়ের দাবি মেনেই বাফেট সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দায়িত্ব হস্তান্তরের। এবং সেই দায়িত্ব পেয়েছেন ৭৭ বছর বয়সী গ্রেগ অ্যাবেল।
গ্রেগ অ্যাবেলের যাত্রাপথও কম চমকপ্রদ নয়। কানাডায় জন্ম নেওয়া অ্যাবেল ১৯৯২ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মিডআমেরিকান এনার্জি-তে যোগ দেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বের গুণ, ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা এবং কোম্পানির সঙ্গে আন্তরিকতার প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি বার্কশায়ারের নন-ইনস্যুরেন্স ব্যবসার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। কর্মীদের প্রতি আন্তরিকতা, আর্থিক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং নৈতিক সিদ্ধান্তের সমন্বয় তাঁকে বাফেটের স্বাভাবিক উত্তরসূরি করে তোলে।
বাফেট নিজেই বলেছেন, “গ্রেগ অ্যাবেলের নেতৃত্বে আমি সম্পূর্ণ আস্থা রাখি। তিনি বার্কশায়ারের মজ্জায় ঢুকে গেছেন। তিনি আমাদের সংস্কৃতি বুঝেন, আমাদের দর্শন লালন করেন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য উপযুক্ত।”
বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা ছিল এক প্রতীক্ষিত ঘোষণা। অনেকেই ভাবছিলেন, বার্কশায়ারের ভবিষ্যৎ কে গড়ে তুলবেন? কোম্পানির ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদ, অসংখ্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং হাজার হাজার কর্মীর দায়িত্ব কার হাতে যাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল এই সভায়—গ্রেগ অ্যাবেল।
তবে বাফেটের বিদায় মানে বার্কশায়ার থেকে তাঁর চূড়ান্ত অবসর নয়। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তিনি কোম্পানির স্ট্র্যাটেজিক পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত থাকবেন। তাঁর স্নেহধন্য সহকর্মী চার্লি মাঙ্গার প্রয়াত হওয়ার পর থেকেই বাফেট কিছুটা নিঃসঙ্গ ছিলেন। তাই কোম্পানির পরবর্তী প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।

এই হস্তান্তরকে অনেকেই দেখছেন কর্পোরেট জগতের ইতিহাসে এক বিরল ও সৌভাগ্যজনক পরিবর্তন হিসেবে। যেখানে নেতৃত্ব বদল হয় কৌশলের ভিত্তিতে, শক্তি নয়; আস্থা ও দূরদৃষ্টির ভিত্তিতে, আধিপত্যের নয়।
গ্রেগ অ্যাবেলের সামনে এখন এক বিশাল দায়িত্ব—ওরেন বাফেটের উত্তরাধিকারকে ধরে রাখা, আর সেইসঙ্গে ভবিষ্যতের বার্কশায়ারকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া। অনেকেই ভাবছেন, অ্যাবেল কি বাফেটের মতোই বিনিয়োগে ধৈর্য ও তীক্ষ্ণতা ধরে রাখতে পারবেন? সময়ই তার উত্তর দেবে।
তবে একটি জিনিস নিশ্চিত—বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এখন এমন একজন নেতার হাতে গেছে, যিনি শুধু যোগ্যই নন, বরং এই দায়িত্বের জন্য মনপ্রাণ দিয়ে প্রস্তুত হয়েছেন বছরের পর বছর।
ওরেন বাফেটের উত্তরসূরি হিসেবে গ্রেগ অ্যাবেল শুধু একটি দায়িত্বই নেননি, বরং বহন করছেন এক দর্শনের উত্তরাধিকার—যেখানে অর্থের চেয়ে মূল্য বেশি, আর মুনাফার চেয়ে নৈতিকতা বড়।