শৈশবের রঙিন স্মৃতি ‘আলিফ লায়লা’—এক চোখের কেহেরমান, সোলেমানি তরবারি আর জাদুর প্রদীপের গল্প

News Desk

“আমাদের শৈশবকে রঙিন করেছে ‘আলিফ লায়লা’। সিরিয়ালটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। স্মৃতিময় দিনগুলো খুব মিস করি।” প্রথম আলোকে এভাবেই বলছিলেন ৩৭ বছর বয়সী দর্শক তাজনিন নাহার।

নব্বইয়ের দশকের আলোচিত টিভি সিরিয়াল ‘আলিফ লায়লা’ নিয়ে এমন আবেগ ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে হাজারো দর্শকের। বিটিভিতে প্রচারের পর সিরিয়ালটি দর্শকমহলে সৃষ্টি করেছিল এক অভাবনীয় সাড়া। প্রতি শুক্রবার রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর টিভির সামনে ছোট-বড় সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়তেন সিরিয়ালটি দেখার জন্য।

স্মৃতিচারণ করে সিলেটের আলমপুরের বাসিন্দা বাহার উদ্দিন ফেসবুকে লিখেছেন, “রাত সাড়ে আটটার আগেই পুরো গ্রামের মানুষের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যেত। উত্তেজনা, ভয় আর আনন্দে ভরা ‘আলিফ লায়লা’র জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকত।”

একইভাবে রাকিব মাহমুদ নামে আরেক দর্শক লিখেছেন, “বিদ্যুৎ না থাকলেও ব্যাটারি চালিত সাদা-কালো টিভিতেই খুঁজে পেতাম আনন্দ। টিভির সামনে চেয়ার পেতে কিংবা পাটি বিছিয়ে বসে যেতাম সবাই মিলে।”

সূচনা সংগীত ‘আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা’ দর্শকদের মনে এক ধরনের জাদুকরি আবেশ তৈরি করত। পারিবারিক পরিবেশে সবাই মিলে এই সিরিয়াল দেখা যেন এক উৎসবের রূপ নিত। সিন্দাবাদ, দস্যু কেহেরমান, আলাদিন, মালিকা হামিরার মতো চরিত্রগুলো এখনো নব্বই দশকের দর্শকদের হৃদয়ে অমলিন।

শিশু-কিশোরদের জীবনেও সিরিয়ালটির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। কেউ বানাতো একচোখা কেহেরমানের মতো ‘চশমা’, কেউ বানাতো সিন্দাবাদের ‘সোলেমানি তরবারি’। মালিকা হামিরার বিচ্ছু আকরামের আদলে খেলনার বাজারও ছিল সরগরম।

‘আলিফ লায়লা’ সিরিয়ালটি আরব্য রজনীর বিখ্যাত গল্প ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোর’, ‘নাবিক সিন্দাবাদ’ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়। ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ব্যানারে এটি নির্মাণ করেন অমৃত সাগর ও শক্তি সাগর। প্রযোজনায় ছিলেন সুভাষ সাগর ও প্রেম সাগর।

সিরিজটির চিত্রনাট্য লিখেছেন দীপালি জানজাপ্পা, সংগীত পরিচালনা করেছেন গৌরব ইসার।

প্রথমবারের মতো ১৯৯৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের ‘দূরদর্শন ২’ চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয় ‘আলিফ লায়লা’। ১৪৩ পর্বের প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য ছিল ২৩ মিনিট। দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহের কারণে এটি বাংলা ভাষায় ডাব করে বিটিভিতে সম্প্রচার শুরু হয়, যা অনেকের মতে বিটিভিতে প্রচারিত প্রথম বাংলা ভাষায় ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল।

ভারতেই বাংলা ভাষায় ডাব করা সিরিজটি বিটিভিতে অবিকৃতভাবে সম্প্রচার করা হয়। এর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত এই চ্যানেল অর্থ পরিশোধ করেছিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে। সিরিজটি দেখে দর্শকরা বিটিভিতে চিঠিও লিখতেন। পত্রিকায় হতো আলোচনা-সমালোচনা।

২০০০ সালের দিকে একুশে টিভিতেও এটি প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে গাজী টিভিতেও সম্প্রচারিত হয়েছে এই জনপ্রিয় সিরিয়াল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত, মিসর, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই সিরিজটি প্রচারিত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ভারতে এটি একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।

অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় সব শিল্পীরা। বাদশাহ শাহরিয়ারের চরিত্রে ছিলেন গিরিজা শঙ্কর, যিনি ‘মহাভারত’-এ অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছিলেন। শেহেরজাদের চরিত্রে ছিলেন দামিনি কানওয়াল শেঠি। আলাদিনের ভূমিকায় ছিলেন নবদীপ সিং। সিন্দাবাদের চরিত্রে ছিলেন শাহনেওয়াজ প্রধান, যিনি ২০২৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ‘রইস’, ‘ফ্যান্টম’ এবং ‘মির্জাপুর’-এর মতো সিনেমা-সিরিজেও অভিনয় করেন।

‘আলিফ লায়লা’ শুধু একটি সিরিয়াল ছিল না—এটি ছিল এক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের রূপকথার স্মৃতি।

Leave a Comment

Footer Section