রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে রাখাইনে মানবিক করিডোর গড়ে তোলার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এক মন্তব্যে জানান, বাংলাদেশ এই বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপরই শুরু হয় জনমনে নানা প্রশ্ন, সংশয় ও বিশ্লেষণ।
গত দুই মাস ধরে রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নানা আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায় মার্চ মাসে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের সময়। রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রমজানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিয়ে তিনি সংকটের গুরুত্ব নতুন করে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। সেই সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের ‘মেহমান’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী রোজা তারা নিজ দেশে পালন করতে পারবেন।
এরপর বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমার পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। যদিও এ বক্তব্য নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে, কারণ আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে দেওয়া এমন ঘোষণা বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে না।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আবারও জানান, আরাকান অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। এরই মধ্যে রাখাইনে মানবিক করিডোর গড়ার প্রস্তাব আলোচনায় আসে, যা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়। যদিও সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো পক্ষের সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি।
মানবিক করিডোর বলতে জাতিসংঘের ভাষায় বোঝায়, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ত্রাণ ও সহায়তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা এবং নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি। অতীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সারায়েভো সংকট, সিরিয়া সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—রাখাইনে মানবিক করিডোর তৈরি কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়ক হবে, নাকি সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করবে? এমন করিডোর গড়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, না কি বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ আরও বাড়বে—এ নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে।
সম্প্রতি আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ চরম চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
এছাড়া সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। মাদক, মানব পাচার ও সহিংসতা ঘিরে সীমান্ত এলাকা অনেক আগে থেকেই হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত। এ অবস্থায় মানবিক করিডোরের নামে সীমান্ত এলাকায় আরও রোহিঙ্গা স্থানান্তর হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাখাইনে করিডোর গড়ে তোলা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভবিষ্যতে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কারণ, এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল মোকাবিলা করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই।
একজন গবেষক হিসেবে বহুবার আমি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি জাতীয় রোডম্যাপ এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে ধরনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা সামনে আসেনি।
রাখাইনে মানবিক করিডোরের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বরং যথাযথ প্রস্তুতি ও রূপরেখা ছাড়া এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে। তখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একটি মরীচিকা হয়ে থাকবে, যা হতাশা সৃষ্টি করবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও।