মায়ের ঋণ, নানার ছায়ায় নিধি

News Desk

মায়ের ঋণ, নানার ছায়ায় নিধি. Dhakainlight.com

১৬ বছর ধরে বিনোদন অঙ্গনে কাজ করছেন আরাফাত মহসীন, সবাই তাঁকে নিধি নামে চেনে। ৫০-৬০টির মতো নাটকে কাজ শেষে এখন চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনায় ব্যস্ত। ‘বরবাদ’ ছবির আবহসংগীতের কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন। শুরু করেছেন আগামী ঈদের ছবির কাজ। স্বপ্ন ছবি নির্মাণের। আরাফাতের গল্প শুনেছেন মনজুর কাদের

আরাফাত মহসীনশিল্পীর সৌজন্যে

দেশ–বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে চলছে ‘বরবাদ’। ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবিটি মাস পেরিয়েছে। ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পেয়েছে। দর্শকের আগ্রহে থাকা ছবিটির আবহসংগীতও প্রশংসা কুড়াচ্ছে। কাজটি করেছেন আরাফাত মহসীন, যে কারণে তিনিও রয়েছেন আলোচনায়। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনায় আরাফাতের অভিষেক ঘটে ২০১৬ সালে ‘আইসক্রিম’ দিয়ে। এরপর ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ প্রকল্পের ‘চিয়ার্স’ কাজটি করেন। বিজ্ঞাপনচিত্র দিয়ে কাজ শুরু করা আরাফাত মহসীন একে একে ‘দামাল’, ‘তুফান’ ও ‘বরবাদ’ ছবির সংগীত পরিচালনার কাজ করেন। জানালেন, ‘তুফান’ ও ‘বরবাদ’ দিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় তিনি। বললেন, ‘“সুড়ঙ্গ” থেকে মিউজিক নিয়ে আলোচনার শুরু হলেও “তুফান” ও “বরবাদ” কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। কারণ, এ ছবিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মিউজিক যুক্ত হয়। এর আগে এতটা লার্জার দ্যান লাইফ মিউজিক হতো না। কয়েক বছর ধরে গল্প যে আয়োজনে গেছে, মিউজিকেও তাই আলাদা নজর দিতে হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষেরাও হলিউড-বলিউডের সিনেমা নিয়মিত দেখেন। ছবি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে হয়েছে, বড় পরিসরের মিউজিক করা উচিত। পিয়ানো দিয়ে বাজিয়ে দিলে চলবে না। বড় আয়োজনের মিউজিকের কারণে প্রেক্ষাগৃহে গল্পের পাশাপাশি শিল্পীদের অভিনয় এবং উপস্থাপনের একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিচ্ছে।’
প্রেক্ষাগৃহের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজ আর ওয়েব ফিল্মের আবহসংগীত ও গানের কাজ করেছেন আরাফাত মহসীন।

এ তালিকায় রয়েছে ‘অল টাইম দৌড়ের ওপর’, ‘ইউটিউমার’, ‘মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট’, ‘বিকেল বেলার পাখি’, ‘মাইনকার চিপায়’, ‘বোধ’, ‘কষ্টনীড়’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘ব্ল্যাক মানি’ ও ‘আমলনামা’। নিজের এত কাজের মধ্যে ‘তুফান’ ও ‘বরবাদ’ সবচেয়ে বেশি আলোচনার ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন শাকিব খান, জানালেন আরাফাত মহসীন। বললেন, ‘শাকিব খানের সিনেমা এবং তাঁর রিলেটেড সবকিছু আমজনতার কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে যায়। দেশে ও দেশের বাইরে তাঁর বিশাল ভক্তকুল রয়েছে। সেই ভক্তদের আমারও নতুন এক্সপেরিয়েন্স দেওয়ার বিষয় আছে। পরিচালকেরা তাঁকে নতুনভাবে উপস্থাপনের কারণে তাঁর দিকে সবার নজর আরও বেশি থাকে। যে কাজে সবার নজর থাকে, সেখানে আমাকে আরও নতুনভাবে প্রমাণেরও বিষয় আছে। শাকিব ভাই দিন শেষে আমার মিউজিককে মানুষের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই চেষ্টা ছিল নতুন কিছু দেওয়ার।’

সিনেমার পোকা
কয়েক বছর ধরে সিনেমার জন্য গান তৈরি আর সংগীত পরিচালনা করলেও ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি প্রেম ছিল আরাফাত মহসীনের। স্কুল ছুটি শেষে বাসায় ফিরে সিনেমা দেখতে বসে যেতেন। কখনো টেলিভিশনে, কখনো ভিসিডি ভাড়া করে এনে। ছবি দেখতে দেখতে দুপুরে ভাত খেতেন।

অনেকের অনেক রকম শখ থাকলেও আরাফাত মহসীনের শখ ছিল সিনেমা দেখা। ছোটবেলায় চিত্রনায়ক মান্নার সিনেমা বেশি দেখা হতো। এ তালিকায় আছে ‘গরীবের বউ’, ‘বাবার আদেশ’, ‘আম্মাজান’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘মাস্তানের উপর মাস্তান’, ‘তেজী পুরুষ’, ‘রাজনীতির খেলা’। দেখতেন রাজ্জাক, জসিম ও রুবেলদের সিনেমাও। রাজ্জাক অভিনীত ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ছুটির ঘন্টা’, ‘অবুঝ মন’, ‘দ্বীপ নিভে নাই’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’ তাঁর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। চিত্রনায়ক আলমগীরের ‘মায়ের দোয়া’ তাঁর প্রিয় সিনেমার একটি। আরাফাত বললেন, ‘স্কুলে থাকতে বাংলাদেশের বাংলা ছবি দেখতে খুব ভালো লাগত। ভারতের বাংলা ছবিও দেখতাম। ওই সময় ছবির মিউজিক বেশ মজার লাগত।’

ঘরে বসে মান্না, রুবেলদের অনেক সিনেমা দেখা হলেও প্রেক্ষাগৃহে প্রথম দেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। আরাফাত জানালেন, নিজে সিনেমায় মিউজিক শুরুর পর ছবি দেখার প্রবণতা আরও বেড়েছে। বললেন, ‘আমি প্রতি শুক্রবার প্রেক্ষাগৃহে বসে দুইটা ছবি দেখার চেষ্টা করি, সেদিন যে দেশের ছবিই দেখানো হোক। দেশের বাইরে ঘুরতে গেলেও এ অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার কাছে এ অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্ব বহন করে। “অ্যানিমেল” দেখছি সিঙ্গাপুরে। বিমান থেকে নামার পর দেখি, হোটেল পাব তিনটায়; এরপর আমি প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে সাড়ে তিন ঘণ্টার সিনেমাটা দেখি। নেপালে উৎসবে গিয়ে “ডুন”, “শয়তান” দেখেছি। চেষ্টা করি প্রেক্ষাগৃহে প্রতিনিয়ত কী চলছে, দেখার। এরপর ভাবতে থাকি, বাইরের দেশের সিনেমায় এত বড় আয়োজনের মিউজিক হলে আমাদের এখানে কেন হচ্ছে না! চেষ্টা করি নিজের কাজে বড় পরিসরে কিছু যোগ করতে।’

 আরাফাত মহসীন

আরাফাত মহসীনশিল্পীর সৌজন্যে

সিনেমা ও গানের আবহে বেড়ে ওঠা
আরাফাত মহসীন বেড়ে ওঠেন সিনেমা ও গানের আবহে। তাঁর নানা আবদুস সবুর ছিলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশক। ‘ঘাতক’, ‘আরাধনা’, ‘বিরহ ব্যথা’, ‘শুভদা’ ছাড়া আরও তিনটি ছবিতে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য মোট সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। মায়ের ফুফাতো ভাই এবং আপন বড় ভাইয়েরা ব্যান্ডে যুক্ত ছিলেন। ছোটবেলার কথা মনে করে আরাফাত মহসীন বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে সিনেমার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। ঢাকার কাফরুলে নানার দোতলা বাড়ি ছিল। সেখানে আমরা থাকতাম। যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। আমার নানা আবদুস সবুর কাজ করতেন খান আতাউর রহমান, বেবী জামানদের সময়ে। ওই সময় থেকে সিনেমা বিষয়টা আমার কাছে বেশ পরিচিত। মামাদের ব্যান্ড ছিল নোভা। এই ব্যান্ডের ফজল আম্মুর ফুফাতো ভাই, বেজ গিটারিস্ট ছিলেন আমার বড় মামা। আম্মুর চাচাতো ভাই ছিলেন চারু। তাঁরা আমাদের দুই ভাইয়ের (আরাফাত কীর্তি ও আরাফাত মহসীন) জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছেন।

চারু মামাসহ তাঁরা আবার নোভার সেকেন্ড লাইনআপে বাজাতেন। সে হিসেবে বলা যায়, সংগীতের সঙ্গেও বেড়ে ওঠা। আমার আব্বু শামসুজ্জামান আখন্দ ও আম্মু মাহমুদা বেগম খেলাঘর করতেন। তবে কখনো পেশাদারভাবে গান করেননি। মা অভিনয়ে নিয়মিত হয়েছেন। এমন পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা।’
কথা প্রসঙ্গে আরাফাত জানালেন, জীবনে কী করবেন—এমনটা যখন ভাবছেন, তখন থেকে মিউজিক করছেন। কারণ, সেটাই ভালো পারছেন। আরাফাত বললেন, ‘দুই বছর বয়স থেকে তবলা বাজাই। ওই জায়গা থেকে সব সময় চেয়েছি, গান-সিনেমায় কীভাবে কী করা যায়। বিজ্ঞাপনচিত্র যখন টিভিতে দেখতাম, তখন ভাবতাম, কীভাবে বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজ করা যায়। বিজ্ঞাপনচিত্র দিয়ে শুরু, এরপর গান। সবারই তো ইচ্ছা থাকে সিনেমায় কাজ করার। হলে সিনেমা দেখার সময় যথাযথ মিউজিকের উপস্থিতি না দেখলে বিরক্ত হতাম। মনে হতো যে এ দৃশ্যের সঙ্গে তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমনটা হচ্ছে! এখন নিজেই করছি। চেষ্টা করছি ভালো কিছু করে যাওয়ার। স্বপ্ন দেখি চলচ্চিত্র নির্মাণেরও। সেই স্বপ্নে পথ চলছি।’

তৃপ্ত, তবে…
শুরু থেকে সিনেমার সংগীত পরিচালনা স্বপ্ন ছিল। দীর্ঘ ১৫ বছর সেই স্বপ্নের পথে নিয়মিত হাঁটছেন আরাফাত মহসীন। একেকটা স্বপ্ন পূরণ হয়, পরক্ষণে আরেক স্বপ্ন সামনে দাঁড়ায়। আরাফাত মহসীন বললেন, ‘এখন যেমন মনে হয়, আরেকটু বড় পরিসরে যদি কাজ করতে পারতাম! আমি চাই যে আরও বেশি মানুষ আমার সঙ্গে কাজে যুক্ত হোক। অর্কেস্ট্রেশনে রেকর্ড করতে চাই, যা পাশের দেশে হরহামেশাই দেখি।

সংগীত পরিচালকেরা যেসব কাজ করেন, প্রায়ই দেখি একসঙ্গে ২০ জন যন্ত্রশিল্পী বাজাচ্ছেন; সেই মিউজিকের শক্তি আমার চেয়ে তো আলাদা হবে, অন্য রকম হবে। সামনে আমিও যেন বলতে পারি, ১৫ কোটি টাকা বাজেটের ছবিতে কাজ করেছেন দেড় শর মতো যন্ত্রশিল্পী। আমি মনে করি, একা আমি বড় হলে তো লাভ নেই। আমার সঙ্গে আরও অনেককে বড় করতে হবে। তাহলে হয়তো বলতেও পারব, একটা ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে। আমরা শুটিং নিয়ে অনেক ভাবি, পোস্টপ্রোডাকশন যে বড় বিষয়, সেদিকেও আমাদের বেশি নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে আসলে প্রতিটা সময়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। “তুফান” করার পর প্রমাণ করতে হয়েছে, “বরবাদ” করতে পারব তো! “বরবাদ” করার পর “তাণ্ডব” পারব তো!’

 আরাফাত মহসীন

আরাফাত মহসীনশিল্পীর সৌজন্যে

সংগীতে প্রেরণা যাঁরা
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করা আরাফাত মহসীন দেশ–বিদেশের অনেকের দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাঁদের সংগীতকর্ম নানাভাবে তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছে, মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। তাঁদের কাজ দেখে নিজেকে বড় পরিসরে কল্পনা করেন তিনি। বললেন, ‘২০০৯ সালে “শার্লক হোমস”–এর একটা ছবি দেখি। রবার্ট ডাউনি জুনিয়র অভিনয় করেন। হ্যান্স জিমার মিউজিকে ছিলেন। আমি তখন ঘরের কম্পিউটারে মাইক্রোল্যাবের স্পিকারে ছবিটি দেখি। কী অসাধারণ সাউন্ড ডিজাইন! মাথা এলোমেলো হওয়ার অবস্থা। এর পর থেকে হ্যান্স জিমারকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। দেখি যে বিশ্বের অনেক অসাধারণ ছবির মিউজিক করেছেন। এ আর রাহমানের মিউজিকেরও খুব ভক্ত আমি। তখন মনে হতো, আমাকেও এ রকম কিছু একটা করতে হবে।’ দেশের মধ্যে জহির রায়হান, আলাউদ্দীন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও আইয়ুব বাচ্চু নানাভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

মায়ের ঋণে স্টুডিও
আরাফাত মহসীনের বাবা শামসুজ্জামান আখন্দ মারা যান ২০০৬ সালে। এরপর ভাবতে থাকেন, কী করবেন। তখন বড় ভাই আরাফাত কীর্তির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান। আরাফাত মহসীন বললেন, ‘কীর্তি ছায়ানটে তবলা শিখেছে, ওকে দেখে আমিও তবলা বাজানো শিখেছি। ওর গিটার বাজানো দেখে আমিও ভেবেছি, কেন পারব না, শিখেছি। এরপর আম্মু আমাকে স্টুডিও করে দেন।’ সেই গল্পটা শোনালেন আরাফাত মহসীন এভাবে, ‘আম্মু আমাকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এটা লোন। তোমাকে ফেরত দিতে হবে ছয় মাসের মধ্যে।” আমি তখন ও লেভেলের একটা পার্ট শেষ করেছি। কীভাবে কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কাজ খোঁজা শুরু করি। তখন আমার জীবনে রাজীব আশরাফ আশীর্বাদ হয়ে আসে। প্রথম কাজ দেয়। সিনেমার পর্দায় যে আজ আমার নাম দেখা যায়, তার কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমার জীবনে সে বড় জায়গাজুড়ে আছে। সেদিন আমাকে কাজ না দিলে আজ এত দূর আসা হতো না। আমার আম্মুদের সংগঠন ছিল, সে সংগঠনে রাজীব ক্লাস ফাইভ থেকেই যুক্ত ছিল। সে আমাকে কাজ দিল। কিন্তু আরও কয়েকজন সেই কাজের পাইপলাইনে ছিল। আমারটা যদি ভালো হয়, তাহলে সিলেক্ট হবে। আমি নিজেকে প্রমাণ করি। কাজ পাই। চার মাসে মায়ের লোন ফেরত দিই। আম্মু তাঁর বাবা ও ভাইদের দেখেছেন, এই অঙ্গনে স্ট্রাগল কেমন। তখন আমাকে সেই টাইমটা বেঁধে দেওয়া দরকারও ছিল। নইলে এতটা সিরিয়াস হতাম না। আমারও হয়তো এত দূর আসা হতো না।’

Leave a Comment

Footer Section