মহাকাশে বিরল এক মহাজাগতিক দৃশ্যের সাক্ষী হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা—প্রথমবারের মতো দুটি গ্যালাক্সির একে অপরের দিকে আক্রমণাত্মক গতিতে ধাবিত হওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে তাদের টেলিস্কোপে। এই সংঘর্ষকে বিজ্ঞানীরা বলছেন এক ‘কসমিক জুস্ট’ বা মহাজাগতিক দ্বন্দ্ব।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের এই দুই গ্যালাক্সি প্রতি ঘণ্টায় ১১ লাখ মাইল গতিতে একে অপরের দিকে ছুটে আসছে। এদের মধ্যে একটি গ্যালাক্সি থেকে আসা তীব্র বিকিরণ অন্যটিকে দুর্বল করে দিচ্ছে, গ্যাস মেঘ ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং তারার জন্ম প্রক্রিয়া থামিয়ে দিচ্ছে।
এই গবেষণার প্রধান লেখক পাসকিয়ে নোতেরদেম প্যারিস ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, “একটি গ্যালাক্সি আরেকটিকে রীতিমতো আক্রমণ করছে, সেই কারণেই আমরা একে বলছি কসমিক জুস্ট।”
এই ঘটনাটি মূলত দুটি গ্যালাক্সির একীভবনের প্রক্রিয়া—যা এখনো চলমান বলে মনে করা হচ্ছে। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল Nature-এ।
‘আক্রমণকারী’ গ্যালাক্সির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কোয়াসার
গবেষণায় দেখা যায়, আক্রমণকারী গ্যালাক্সির মূল বিকিরণ আসে একটি কোয়াসার থেকে, যা একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল দ্বারা চালিত। এই কোয়াসার থেকে নির্গত অতিবেগুনি রশ্মি আমাদের মিল্কিওয়ের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী। ফলে পাশের গ্যালাক্সির তারার জন্ম দেওয়া গ্যাসমেঘগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
ব্ল্যাক হোলের গুঁজিৎ আকর্ষণে ধুলো ও গ্যাস ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড উত্তাপে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এদের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আকরেশন ডিস্ক এবং তার কেন্দ্র থেকে শক্তিশালী জেট রশ্মি ছুটে বেড়ায় মহাশূন্যে।
গবেষক সের্গেই বালাশেভ বলেন, “এটি প্রথমবার যে আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি কীভাবে একটি কোয়াসারের বিকিরণ কাছাকাছি থাকা গ্যালাক্সির গ্যাসকে প্রভাবিত করছে।”
ALMA টেলিস্কোপে ধরা পড়ল ‘গ্যালাক্সি জোড়া’
এই তথ্য সংগ্রহ করা হয় চিলির আতাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে (ALMA) এবং ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (VLT)-এর মাধ্যমে। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এটি একটি কোয়াসার, কিন্তু উচ্চ রেজুলেশনের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আসলে এটি দুটি আলাদা গ্যালাক্সি।
দুটি গ্যালাক্সি দেখতে একসঙ্গে লাগলেও তারা হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। গবেষকদের মতে, এখন হয়তো এরা একীভূত হয়ে গেছে, কিন্তু এত দূরত্বের কারণে সুনিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
মহাবিশ্বের অতীত জানার জানালা খুলল
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্স সেন্টারের বিজ্ঞানী ডং-উ কিম বলেন, প্রাচীন মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংঘর্ষ ও কোয়াসার ছিল অনেক বেশি সাধারণ। তখন গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের অনেক কাছাকাছি ছিল।
নোতেরদেম বলেন, ১০ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বের ইতিহাসে এক সময় ছিল ‘নুন অফ দ্য ইউনিভার্স’, যখন তারা জন্মাতো প্রচুর হারে। এই গবেষণা সেই সময়কার এক ঝলক তুলে ধরেছে।
এই ধরনের পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে আমাদের শেখাবে গ্যালাক্সির জন্ম, বিকাশ ও পরিবর্তনের বিবর্তন কেমন হয়। এমনকি, আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিও একসময় অ্যান্ড্রোমিডার সঙ্গে একীভূত হবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এটি শুধু দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষ নয়, বরং মহাবিশ্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা প্রাণবন্ত এক রূপকথা, যা আমাদের জানিয়ে দেয় তারাদের, গ্যাসের, ধুলোর এবং এক মহাকর্ষীয় নৃত্যের কাহিনি।