ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে বাঁচতে গিয়ে নিজেদের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন পম্পেইয়ের চারজন

News Desk

Updated on:

ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে বাঁচতে গিয়ে নিজেদের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন পম্পেইয়ের চারজন. Dhakainlight.com

প্রাচীন রোমান নগরী পম্পেইয়ের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে চারজন — যার মধ্যে একজন শিশু — ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাত্মক অগ্ন্যুৎপাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই বাড়িই তাদের চিরস্থায়ী বিশ্রামের স্থান হয়ে ওঠে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এই হৃদয়বিদারক তথ্য উঠে এসেছে।

‘হেলি ও ফ্রিক্সাসের বাড়ি’ নামে পরিচিত একটি বাড়িতে এই আবিষ্কার করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। বাড়িটির নামকরণ হয়েছে গ্রিক পুরাণের একটি চিত্রকর্মের নাম অনুসারে, যা সেই বাড়ির ভোজকক্ষের দেয়ালে আঁকা ছিল।

গবেষকেরা জানান, ২০১৮-১৯ সালে বাড়ির সামনের অংশ আংশিক খনন করা হয়েছিল। পরে গবেষণার উদ্দেশ্যে নতুন করে খনন করে বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ উন্মোচন করা হয়। বাড়িটি সংরক্ষণ ও ভবিষ্যতে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

গবেষণায় জানা যায়, অগ্ন্যুৎপাতের প্রথম ধাপে ছাই ও গরম গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং ছাই ও ঝরা আগ্নেয়শিলা (পিউমিস) পম্পেই নগরীকে ঢেকে ফেলে। খননকারীরা আবিষ্কার করেন, চারজন ব্যক্তি আগ্নেয়গিরির আক্রমণ থেকে বাঁচতে একটি ঘরের দরজা বিছানা দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, তারা প্রথমে বিছানা দিয়ে দরজা রুদ্ধ করেন, কিন্তু পরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বিছানাটি সরিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত তারা ভোজকক্ষে মারা যান।

গবেষক দল বিশ্বাস করেন, প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা আগ্নেয় ধ্বংসস্তূপ এবং গরম ছাই ও গ্যাসের মিশ্রণে গঠিত পাইরোক্লাস্টিক মেঘের ধাক্কায় চারজনের মৃত্যু ঘটে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ঘরে পড়ে থাকা কাঠের খাটের ফ্রেমের গহ্বর থেকে ছাঁচ তৈরি করে সেটিকে প্লাস্টার দিয়ে পূরণ করে সংরক্ষণ করেছেন।

পম্পেই প্রত্নতত্ত্ব পার্কের পরিচালক গ্যাব্রিয়েল জুচত্রিগেল বলেন, “পম্পেই খনন করা মানেই কেবল প্রাচীন শিল্পের সৌন্দর্যের মুখোমুখি হওয়া নয়, বরং জীবনের অনিশ্চয়তার সঙ্গেও সরাসরি সাক্ষাৎ।”

তিনি জানান, ঐ বাড়িটি অগ্ন্যুৎপাতের সময় সংস্কারের কাজ চলছিল। অথচ সেই বাড়ির দেয়ালে আঁকা পুরাণের চিত্রই যেন সেই ট্র্যাজেডির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল। চিত্রকর্মে দেখা যায়, গ্রিক পুরাণের দুই ভাই-বোন হেলি ও ফ্রিক্সাস এক হিংস্র সৎমায়ের হাত থেকে পালানোর সময় সোনালী পশমবিশিষ্ট এক ভেড়ায় চড়ে উড়ে যাচ্ছে। তবে হেলি সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নিচে পড়ে যায়। সেই জায়গাকেই পরবর্তীতে হেলিসপন্ট নামে অভিহিত করা হয়।

চিত্রকর্মে হেলিকে দেখা যায়, সে সমুদ্রে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তার ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে। গবেষকদের মতে, এই দৃশ্য যেন বাস্তবেও ঘটেছে — যখন পম্পেইয়ের ওই চার বাসিন্দা জীবনের শেষ মুহূর্তে আশার শেষ চেষ্টাটুকু করেছিলেন।

গবেষণায় আরও জানা যায়, বাড়িটির নিচতলায় একটি গুদামে আমফোরা নামক দুই হ্যান্ডেলের বড় মাটির পাত্র পাওয়া গেছে, যা সেই সময় তরল পদার্থ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো। কিছু পাত্রে পাওয়া গেছে গারাম — একধরনের ঝাঁঝালো মাছের সস, যা রোমানদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। এছাড়াও পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জের পাত্র, ঝিনুক আকৃতির কাপ, ঝুড়ির মতো দেখতে পাত্র, একটি হাতলযুক্ত জগ এবং লাডেল।

একটি ব্রোঞ্জের বুলাও পাওয়া গেছে, যা রোমান ছেলেরা শিশু অবস্থায় থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত পরিধান করত। এটি একটি সুরক্ষা তাবিজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

জুচত্রিগেল বলেন, “পম্পেইয়ের প্রতিটি বাড়িই একেকটি অনন্য গল্প বলে। প্রতিটি বাড়ির আলাদা রূপ, সাজসজ্জা, এবং বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত পছন্দ, স্বপ্ন ও ট্র্যাজেডির প্রতিফলন দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে।”

তিনি আরও বলেন, “হেলি ও ফ্রিক্সাসের বাড়িটি ছোট হলেও এর দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্মগুলো প্রমাণ করে, ওই বাড়ির বাসিন্দারা সমাজে উঁচুতে উঠতে চেয়েছিলেন। তবে একই সময়ে, তারা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়েও সজাগ ছিলেন।”

এভাবেই পম্পেইয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রতিটি ঘর, প্রতিটি চিত্রকর্ম এবং প্রতিটি নিদর্শন যেন হাজার বছর আগেকার মানুষের আশাভরসা, দুঃখ-কষ্ট, ও জীবনের শেষ মুহূর্তের কাহিনি নতুন করে বলছে।

Leave a Comment

Footer Section