রাজধানীর সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রী পারাপার করান নৌকার মাঝি খলিলুর রহমান (৪২)। বুড়িগঙ্গায় এখন সাকার ফিশ পাওয়া যায় কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, সাকার ফিশ অনেকটাই কমে গেছে।
সাকার ফিশে ভরা ছিল দেশের অত্যন্ত দূষিত নদী হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা। সে নদী থেকে এত সাকার ফিশ কোথায় গেল, জানতে চাইলে খলিলুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে বলেন ফজলু মিয়ার কথা।
‘ফজলু একাই সব সাফা কইরা দিছেন,’ বলেন খলিল। ফজলু মিয়াকে কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁকে পাওয়া যাবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গার পাড়সংলগ্ন বেবি সাহেবের ঘাটে।
লিলের নৌকা নিয়েই ৭ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে রওনা দিলাম ফজলু মিয়ার সন্ধানে। সদরঘাটে নোঙর করা বড় সব লঞ্চের ফাঁকফোকর দিয়ে খলিলের নৌকা চলা শুরু করল। ২০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম বেবি সাহেবের ঘাট এলাকায়, যেটি সদরঘাট থেকে বাঁ দিকে কিছু দূরে। ঘাটে গিয়ে খলিল একটি নৌকা দেখিয়ে বললেন, এটি ফজলুর। কিন্তু তিনি নেই।
ফজলুর সন্ধানে এসেছি, সেটা জানার পরে আশপাশের মাঝিরা বললেন, ‘ফজলু এখন ভাইরাল।’ অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ফজলুর কীর্তি। মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুড়িগঙ্গায় যাঁরা সাকার ফিশ ধরেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ফজলু। দিনের পর দিন তাঁর মতো কেউ সাকার ফিশ ধরেনি।
মাঝিদের কয়েকজন জানান, ফজলু তাঁর বাসায় আছেন। জুমার নামাজের পরে দেখা দেখা পাওয়া যেতে পারে, এমনটা জানালেন তাঁরা। কেউ একজন খবর পাঠিয়েছেন ফজলুর বাসায়।
বেলা দুইটার আগে ফজলুর দেখা পাওয়া গেল ঘাটে আসার সরু পথে। কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, ‘আমি ভাইরাল ফজলু।’
সাকার ফিশের মতো মাছ কেন ধরতে গেলেন, তা জানতে চাইলে ফজলু মিয়া (৪০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাগে, ক্ষোভে।’
‘আগে বুড়িগঙ্গা থিকা থেকে শিং মাছ ধরতাম। সঙ্গে আসত অল্প কয়েকটা সাকার মাছ। গত বছর থিকা দেখি জাল ফেলাইলে ডজনে ডজনে এ মাছ উঠত। এত রাগ লাগতাছিল বলে বুঝাইতে পারব না,’ বলেন ফজলু।
ফজলুর ভাষ্য, তিনি তখনই সিদ্ধান্ত নেন, যত পারেন সাকার ফিশ বুড়িগঙ্গা থেকে তুলে ফেলবেন। এক বছর ধরে তিনি নিয়মিত সাকার ফিশ ধরেছেন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। তিনি মূলত ঝাঁকি জাল দিয়ে সাকার ফিশ ধরতেন।
মাস তিনেক আগে ফজলুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায়, তিনি নৌকা বোঝাই করে সাকার ফিশ বিক্রি করছেন।
‘বুড়িগঙ্গার কোনোহানে এখন আগের মতো সাকার ফিশ পাইবেন না,’ যেন একটা যুদ্ধজয়ের গর্ব নিয়ে বললেন ফজলু। তিনি বলেন, প্রথম দিকে সাকার বিক্রি করার সময় অনেকে তাঁর সঙ্গে মজা করতেন। তবে একজন ৫০ টাকা দিয়ে দুই কেজি সাকার ফিশ কিনে নিয়েছিলেন।
‘যেদিন প্রথম বেচা শুরু করছি কেজি ২০ টাকা, অনেকে আইসা কয়, আগে তুই খাইয়া দেখা। আমি কইলাম, আমি খাইয়া দেখামু, তয় কেজি ৭০০ টাকা দেওন লাগব। এরপর ওই লোক আর মজা করে নাই,’ হাসতে হাসতে বলেন ফজলু।
ফজলুর ভাষ্য, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর কয়েকজন পোলট্রি খামারি সাকার ফিশ কেনার জন্য সাভার থেকে এসেছিলেন। ওই দিন কাজে বাইরে ছিলেন ফজলু। ফলে তিনি তাঁদের কাছে মাছ বিক্রি করতে পারেননি। কেউ কেউ বিক্রি করেছেন।
কারা এসেছিলেন, জানতে চাইলে ফজলু বলেন, ‘সাভার থিকা আইছিল। মাছের খামার, পোলট্রি খামার, কেউ কেউ কুমিরের খামারের জন্যও লইয়া যায়।’ তবে তিনি কারও নাম বা ফোন নম্বর জানাতে পারেননি।
ফজলু দাবি করেন, তিনি সাকার ফিশ ধরার পর তা ফেলে দিতেন। কিছু কিছু বিক্রি হয়েছিল।
ফজলু মিয়া পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা থেকে বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসেন প্রায় ৩০ বছর আগে। স্বামী, স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই নাতি মিলিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারে তিনি ও ছেলে আয় করেন। ছেলে লঞ্চের ডেকে পান বিক্রি করেন। টানাটানির সংসারে মেয়েকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন।
বেবি সাহেবের ঘাট এলাকাটি পড়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর খেজুরবাগ এলাকায়। এখানে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন ফজলু। ঘাট থেকে একটা সরু সড়ক সোজা চলে গেছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে। সেখানে মূলত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা থাকেন।
ফজলুর বিষয়ে বেবি সাহেবের ঘাটে কথা হয় নৌকার মাঝি মো. সিরাজের (৬০) সঙ্গে। তিনি বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপার করেন। তিনি ফজলুকে চেনেন ২৫ বছর ধরে। থাকেন ফজলুর সঙ্গে একই এলাকায়।
সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, আগে নদীতে নামলেই সাকার ফিশ পায়ের নিচে পড়ত। পায়ের গোড়ালিতে লাগত।
এহন আর গায়ে লাগে না। ফজলু সব সাফ কইরা ফেলাইছে,’ বলেন সিরাজ।
ফজলু বলেন, বর্ষাকালে এ মাছ আবার ফিরে আসতে পারে। সে জন্য অনেক বড় একটা জাল বোনাচ্ছেন তিনি। বর্ষা আসতে আসতে জাল বানানো শেষ হবে। তখন সাকার যদি ফিশ না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য মাছ ধরবেন তিনি। বর্ষায় বুড়িগঙ্গায় শিং, মাগুরসহ কিছু মাছ পাওয়া যায়।