উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা আর নেই। ‘পেপে’ নামে পরিচিত এই জনপ্রিয় নেতা ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সাদামাটা জীবনযাপন, ভোগবাদবিরোধী মনোভাব ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার কারণে মুহিকা পরিচিত ছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ নামে। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় নিজের সরকারি বাসভবনে না থেকে তিনি রাজধানী মন্তেভিদেওর বাইরের একটি খামারবাড়িতে জীবন কাটাতেন এবং নিজের গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন পুরোনো একটি ভক্সওয়াগেন বিটল।
হোসে মুহিকার মৃত্যু সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি। এক্স প্ল্যাটফর্মে দেওয়া বার্তায় তিনি লিখেছেন, “আপনি আমাদের যা দিয়েছেন এবং এই দেশের মানুষদের প্রতি আপনার গভীর ভালোবাসা ছিল, তার জন্য কৃতজ্ঞতা।”
সাবেক গেরিলা যোদ্ধা থেকে রাষ্ট্রপ্রধান
তরুণ বয়সে হোসে মুহিকা ‘ন্যাশনাল পার্টি’র সদস্য ছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি রাজনীতির আরও বামঘেঁষা ধারায় যুক্ত হন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি গড়ে তোলেন ‘টুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট’ (এমএলএন-টি) নামে একটি বামপন্থী গেরিলা সংগঠন। এই সংগঠন হামলা, অপহরণ ও সহিংসতায় জড়িত ছিল। যদিও মুহিকা সবসময় দাবি করতেন, তিনি নিজে কাউকে হত্যা করেননি।
এই সময়ে তিনি চারবার গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৭০ সালে এক অভিযানে ছয়বার গুলিবিদ্ধ হন। একাধিকবার তিনি কারাগার থেকে পালান, যার মধ্যে একবার ১০৫ জন সহযোদ্ধার সঙ্গে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালানো ছিল উরুগুয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় কারা পালানোর ঘটনা।
সেনা শাসনামলে নির্মম কারাবাস
১৯৭৩ সালে উরুগুয়ের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মুহিকাকে ‘৯ জিম্মি’র মধ্যে রাখা হয়, যাদের জীবন গেরিলা হামলার ওপর নির্ভর করত। সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছিল, হামলা হলে এই ৯ জনকে হত্যা করা হবে।
দীর্ঘ ১৪ বছরের কারাবাসে মুহিকা বিচ্ছিন্ন, অমানবিক পরিবেশে ছিলেন। তিনি বলতেন, এই বন্দিজীবনে তিনি এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং পিঁপড়ার সঙ্গেও কথা বলতেন। কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯৮৫ সালে, গণতন্ত্র ফিরে আসার পর।
নতুন জীবন, নতুন রাজনীতি
মুক্তির পর মুহিকা আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৫ সালে ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় কৃষিমন্ত্রী হন। ২০১০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৪ বছর।
রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তিনি বিলাসবহুল জীবন পরিহার করে কৃষিকাজে যুক্ত থাকতেন। নিজের আয়ের বড় একটি অংশ দান করতেন সমাজসেবায়। তিনি বলতেন, “আমি দরিদ্র নই, কারণ আমার চাহিদা কম। যাদের চাহিদা বেশি, তারাই প্রকৃত দরিদ্র।”
বিশ্বজুড়ে প্রশংসা
মুহিকার নেতৃত্ব এবং জীবনদর্শন তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি ছিলেন ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার এক বাস্তব উদাহরণ। নিজের আদর্শিক অবস্থান থেকে কখনও বিচ্যুত হননি এবং বিশ্বের অনেক রাজনীতিকের কাছে এক অনন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।
উরুগুয়ের মতো ছোট একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে বৈশ্বিক স্তরে এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। তবে দেশের অভ্যন্তরে তাঁর নীতিনির্ধারণ নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ভালোবাসার প্রতীক।
রাজনীতিতে নৈতিকতার বিরল দৃষ্টান্ত রেখে হোসে মুহিকা আজ বিদায় নিলেন, কিন্তু তাঁর আদর্শ, জীবনদর্শন ও সরলতা চিরকাল মানুষের মনে জেগে থাকবে।
4o