১৯৬৪ সালের ২৮ মে, মিসরের কায়রোতে আরব লিগের সম্মেলনে যাত্রা শুরু করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। সেই সময় ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন প্রবল হয়ে উঠেছিল। পিএলওর জন্মও হয়েছিল সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে। তবে ছয় দশক পেরিয়ে আজ যখন পিএলওর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—এই সংগঠন আদৌ কতটা এগিয়েছে জনগণের স্বপ্ন পূরণের পথে?
১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন বিভক্ত করে আলাদা ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও, ফিলিস্তিনি আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দীর্ঘ সংঘাতের সূত্রপাত, যার ফলাফল হিসেবে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়।
পরবর্তী সময়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় পিএলও। এটি ছিল একটি ছাতার মতো সংগঠন, যেখানে একাধিক রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দল অংশ নেয়। শুরুতে প্রতিরোধ ছিল সশস্ত্র এবং কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্বাধীনতা। পরে পিএলও ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনৈতিক আপসের দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৬৯ সালে ইয়াসির আরাফাত পিএলওর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাঁর সময়েই পিএলও প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বক্তব্য দেন আরাফাত। যদিও তখন থেকেই শুরু হয় আপসের রাজনীতি।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি পিএলওর ইতিহাসে একটি বড় বাঁক পরিবর্তন আনে। এর মাধ্যমে গঠিত হয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বা পিএ। এই চুক্তির কারণে আরাফাত নিজে ও অনেক ফিলিস্তিনি নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। তবে একে অনেকেই ‘ব্যর্থ আপস’ হিসেবে দেখেন—কারণ এতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা ছিল না।
পিএ আজ একটি সীমিত ক্ষমতার প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। কর আদায়, নিরাপত্তা এবং চলাচলের ওপর ইসরায়েলের কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। পশ্চিম তীরে প্রতিনিয়ত অভিযান চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ।
২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর ফলে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে শুরু হয় বিভক্তি, যা আজও অব্যাহত। এই বিভক্ত রাজনীতির ফাঁদে পড়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্য আর ফিরে আসেনি।
পিএর বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২০০৫ সাল থেকে পদে আছেন, কিন্তু কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। ৮৯ বছর বয়সী এই নেতা এখনও পিএলও ও পিএ দুটোই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পিএলওতে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ তৈরি করে হুসেন আল-শেখকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করায় নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামত যাচাই না করে এভাবে উত্তরসূরি নির্বাচন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়াতে পারে। পার্লামেন্ট নেই, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নেই, আর জনগণের আশা—সেটিও বারবার পিছিয়ে পড়ছে।
পিএলও এখন আর আগের মতো কার্যকর সংগঠন নয় বলেই অনেক বিশ্লেষকের মত। একদিকে ইসরায়েলের দমননীতি, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার বিভক্তি—এই দুইয়ের চাপে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন এখন অনেকটাই ক্ষীণ।
ছয় দশক পেরিয়ে আজ পিএলও একটি প্রতীকী কাঠামোতে রূপ নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই কাঠামো কি এখনও সেই আদর্শ বহন করে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির সংগ্রাম?
পূর্বসূরিদের সংগ্রাম, রাজনৈতিক আপস, বিভক্ত নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক চাপের এই জটিল বাস্তবতায় পিএলওর ভবিষ্যৎ কী—তা নির্ভর করছে ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ হতে পারার ক্ষমতার ওপর। সময়ই বলে দেবে পিএলও আবার সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের পথে ফিরে যেতে পারবে কিনা।