ইসরায়েলের হামলায় বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় শিশুদের ওপর যুদ্ধের নির্মম ছায়া নেমে এসেছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চলতি বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৯ জন শিশু নিহত হয়েছে এবং আরও ৩ হাজার ৭৩৮ জন আহত হয়েছে।
ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যে আরও বলা হয়, গড় হিসেবে গাজায় প্রতি ২০ মিনিটে একটি শিশু হয় নিহত, না হয় আহত হচ্ছে। এই পরিসংখ্যান শুধু একটি সংখ্যা নয়—এটি প্রতিটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শৈশবের প্রতিচ্ছবি, একটি মানবিক বিপর্যয়ের জ্বলন্ত প্রমাণ।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এই অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “জীবনের ধ্বংস” হিসেবে। তিনি বলেন, “বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল—সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে কোনো শিশুর বেঁচে থাকার কথা নয়। আর একটি শিশুও নয়।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এরা শুধু সংখ্যা নয়, এরা মানুষ, ছোট ছোট জীবন—যাদের প্রতিটি ক্ষয় আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।”
গেল সপ্তাহান্তে গাজায় দুটি ভয়াবহ হামলার কথা তুলে ধরেন ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক এদুয়ার বেগবেদে। একটি ঘটনায়, খান ইউনিসে আল-নাজ্জার পরিবারের ১০ ভাইবোনের মধ্যে ১২ বছরের নিচে একমাত্র একটি শিশু জীবিত রয়েছে—তাও গুরুতর আহত। আরেক হামলায় গাজা সিটির একটি স্কুলে ভোররাতে আগুনে পুড়ে ৩১ জন নিহত হয়, যার মধ্যে ১৮ জনই শিশু।
শুধু হতাহতের সংখ্যাই নয়, গাজায় প্রতিনিয়ত শিশুরা অভূতপূর্ব দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা—সবকিছুর অভাব চরমে। গাজা উপত্যকার জীবনযাত্রা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষুধা ও সহিংসতার এই চক্রে একেকটি শিশু যেন হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।
ইউনিসেফ তাদের বিবৃতিতে আরও জানিয়েছে, গাজায় শিশুদের জীবন যে মাত্রায় বিপন্ন, তা শুধু যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব নয়; বরং খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াও বড় ভূমিকা রাখছে। “ত্রাণ প্রবেশে বাধা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বারবার জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি—সব মিলিয়ে গাজায় আজ শিশুরা সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে,” বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
সংস্থাটি আহ্বান জানিয়েছে, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করতে, বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে শিশুদের রক্ষা করতে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসরণ করতে এবং গাজায় মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে। একইসঙ্গে তারা যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের জবাবদিহিরও আহ্বান জানিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। ক্যাথরিন রাসেল বলেন, “আর কত শিশুর লাশ লাগবে? কত ভয়াবহতা সম্প্রচারে এলে বিশ্বজুড়ে মানবতা জেগে উঠবে? এ নির্মমতা থামাতে এখনই প্রয়োজন সাহসী ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ।”
গাজায় আজ মানবতার অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। শিশুরা বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে, যেখানে তাদের খেলার কথা, শেখার কথা, বেড়ে ওঠার কথা। তারা যুদ্ধ চায়নি, তবুও তারাই সবচেয়ে বড় শিকার। এখন প্রয়োজন, সমগ্র বিশ্ব যেন এক কণ্ঠে উচ্চারণ করে—আর না। এখনই সময় শিশুদের জন্য শান্তি ফিরিয়ে আনার।