পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্বর্ণ উঠে আসছে, বলছে নতুন গবেষণা

News Desk

পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্বর্ণ উঠে আসছে, বলছে নতুন গবেষণা. Dhakainlight.com

পৃথিবীর অভ্যন্তরে, গলিত ধাতুর কেন্দ্রস্থলে লুকিয়ে রয়েছে প্রায় সম্পূর্ণ স্বর্ণভাণ্ডার—৯৯.৯৫ শতাংশেরও বেশি। এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল এই মূল্যবান ধাতু সেখানেই বন্দী রয়েছে চিরতরে। তবে এক নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীর কেন্দ্রের সেই স্বর্ণ ছোট ছোট পরিমাণে বাইরে বের হয়ে আসছে, যা লাভার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে।

জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব গটিনজেন-এর ভূ-রসায়নবিদ নিলস মেসলিং-এর নেতৃত্বে পরিচালিত তিন বছরব্যাপী গবেষণায় হাওয়াইয়ের আগ্নেয়গিরির উৎসস্থল থেকে সংগ্রহ করা আগ্নেয় শিলার মধ্যে পাওয়া গেছে এক বিরল ধাতু—রুথেনিয়ামের আইসোটোপ। এই আইসোটোপ সাধারণত শুধুই পৃথিবীর কেন্দ্রে পাওয়া যায়। আর এখানেই ধারণার নতুন মোড়: যদি রুথেনিয়াম কেন্দ্র থেকে উঠে আসতে পারে, তাহলে স্বর্ণও ঠিক একইভাবে উঠে আসছে।

গবেষণাপত্রটি গত ২১ মে প্রকাশিত হয় ‘নেচার’ জার্নালে। সেখানে বলা হয়, “পৃথিবীর কেন্দ্র এবং আবরণ অংশ একে অপরের থেকে এতটাই ভিন্ন ঘনত্বের, ঠিক যেন তেল আর পানি। ফলে তাদের মিশ্রণ বা আদান-প্রদানের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া এতদিন সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমাদের এই গবেষণায় পাওয়া নতুন রসায়নিক সংকেত বলছে, কিছু পরিমাণ উপাদান এখনো কেন্দ্র থেকে ম্যান্টলে এবং সেখান থেকে লাভার মাধ্যমে পৃষ্ঠে আসছে।”

পৃথিবীর গঠন অনুসারে, কেন্দ্রে রয়েছে দুটি স্তর—একটি কঠিন লোহার বল এবং তার চারপাশে গলিত ধাতুর তরল স্তর। এই তরল অংশই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরির জন্য দায়ী। তার উপরেই রয়েছে কঠিন শিলার আবরণ, যেটি প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার পুরু।

হাওয়াইয়ের আগ্নেয় শিলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে থাকা রুথেনিয়ামের আইসোটোপটি সেই আদিম উপাদানগুলোর মধ্যে পড়ে, যা পৃথিবী গঠনের সময় মেটিওরাইটের মাধ্যমে কেন্দ্রে চলে গিয়েছিল। আর এই সংকেত শুধু হাওয়াইয়ের মত হটস্পট আগ্নেয়গিরির শিলাতেই পাওয়া গেছে, অন্য কোথাও নয়।

গবেষকেরা বলেন, “এই রুথেনিয়াম যখন পাওয়া গেছে, তখন সেটা ছিল এক কেজিরও কম আগ্নেয় শিলা থেকে। এর মধ্যে রুথেনিয়ামের পরিমাণ ছিল কয়েক মিলিগ্রামেরও কম—পৃথিবীজোড়া বিশাল খড়ের গাদার মধ্যে সূচ খোঁজার মতো কাজ।” যদিও এটি খুবই ক্ষুদ্র পরিমাণ, তবু এটিই নিশ্চিত করে যে পৃথিবীর কেন্দ্র সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়।

গবেষণায় আরো বলা হয়, রুথেনিয়াম যেমন গঠন ও রাসায়নিক গুণে স্বর্ণের সমতুল্য, তেমনি যদি কেন্দ্র থেকে রুথেনিয়াম ওঠে, তবে স্বর্ণও উঠছে। তবে এই ওঠা প্রক্রিয়া খুবই ধীর। এর মধ্যে কোনো খনিজ খনি গড়ে ওঠার মতো পরিমাণ নেই, তবে কোটি কোটি বছরে যদি এই ক্ষুদ্র ধারা অব্যাহত থাকে, তবে পৃথিবীর স্বর্ণভাণ্ডারে কেন্দ্র থেকেও কিছুটা অবদান থাকতেই পারে।

গবেষক মেসলিং বলছেন, “এটি এমন এক ধারণা যা আমাদের ভাবনার সীমানা প্রসারিত করে। যদি এই ধীর প্রক্রিয়া ৪.৫ বিলিয়ন বছর ধরে চলে, তবে এটি আমাদের পৃথিবীর উপাদানগত গঠন পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে।”

এই গবেষণা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলেন উইলিয়ামস জানান, “এই ফলাফল অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ। এটি পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, হাওয়াইয়ের মতো হটস্পট অঞ্চল থেকে উঠে আসা লাভার মধ্যে পৃথিবীর কেন্দ্রের উপাদান রয়েছে।”

পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী জেসি রেইমিক বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ে বিতর্ক চলছিল। কিন্তু নতুন এই গবেষণা বেশ শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেছে—কেন্দ্র থেকে উপাদান ম্যান্টলে যাচ্ছে। এটি সত্যিই নতুন যুগের সূচনা।”

অবশ্য এই তথ্যের ভিত্তিতে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের কোনো সম্ভাবনা এখনো নেই। কারণ পৃথিবীর কেন্দ্রের যে স্তরে এই ধাতু রয়েছে, তা মানবজাতির সবচেয়ে গভীর খননের চেয়েও ২৩৬ গুণ গভীরে অবস্থিত। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে হয়তো একদিন এই গভীরতাও অতিক্রম করা সম্ভব হতে পারে।

পৃথিবীর কেন্দ্র যে বিচ্ছিন্ন নয়, এবং তার উপাদান আমাদের উপরিভাগে আসছে—এই আবিষ্কার ভূবিজ্ঞান ও রসায়নের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল, যা আমাদের গ্রহ সম্পর্কে জানার গতিপথই বদলে দিতে পারে।

Footer Section