রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী বিজয় দিবসের প্যারেডে এবার বিশ্ববাসীর চোখ ফেরাল মস্কো। শুক্রবার মস্কোর রেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত ৯ মে’র বিজয় দিবস প্যারেডে কেন্দ্রীয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর সম্মানিত অতিথি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা।
এবারের অনুষ্ঠানটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী। ঐতিহ্যগতভাবে দিনটি সেই ২৫ থেকে ২৭ মিলিয়ন সোভিয়েত সেনা ও সাধারণ নাগরিকের স্মরণে উদ্যাপন করা হয়, যারা যুদ্ধের সময় প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রিক আগ্রাসনের পর থেকে এই দিবস একটি রাজনৈতিক বার্তার মঞ্চে রূপ নিয়েছে। পুতিন বরাবরের মতো এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে ‘গ্রেট প্যাট্রিয়টিক ওয়ার’-এর ধারাবাহিকতা হিসেবে চিত্রায়ন করেছেন।
চলতি বছরের প্যারেডটি ছিল অনেক বেশি আয়োজনে ভরপুর। অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি সংখ্যক মিত্র রাষ্ট্রনেতা এতে অংশ নেন। তাদের অনেকে ‘সেন্ট জর্জের ফিতা’ (কালো-কমলা রঙের) বুকে লাগিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন, যদিও এই প্রতীক ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সমর্থনের প্রতীক হিসেবে সমালোচিত এবং বহু দেশে এটি নিষিদ্ধ।
এবারের আয়োজনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতাদের মধ্যে ছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচ, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এসব নেতার উপস্থিতি গত বছরের তুলনায় রাশিয়ার কূটনৈতিক অবস্থানকে অনেক বেশি দৃঢ় দেখিয়েছে।
এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইইউ’র কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে এটি ছিল বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণকারী ঘটনা।
তবে এই বিজয় দিবসের আগেই বিতর্ক শুরু হয় একতরফা যুদ্ধবিরতি নিয়ে। গত মাসে পুতিন ৯ মে’র উৎসব ঘিরে তিন দিনের একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। ইউক্রেন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একে রাজনৈতিক প্রহসন বলে আখ্যা দেয়। ইউক্রেন জানায়, পুতিনের ঘোষণার পরও শত শতবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে রাশিয়া, এবং এতে বেসামরিক নাগরিক নিহত ও আহত হয়েছেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, “আমরা কোনো প্রহসনে যাব না যাতে পুতিন পশ্চিমা বিশ্বে নিজেকে পুনরায় গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতে পারেন।”
প্যারেড শুরুর আগেই ইউক্রেন একাধিক ড্রোন হামলা চালায় মস্কোতে, যার জেরে রাজধানীর চারটি বিমানবন্দর বন্ধ রাখতে হয়। একই সঙ্গে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া—তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় মস্কোগামী কূটনৈতিক বিমানের জন্য, যার কারণে অনেক রাষ্ট্রনেতাকে বিকল্প রুটে যাত্রা করতে হয়।
এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেন স্লোভাক প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো। তিনি বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত বিঘ্ন সৃষ্টিকারী।” সার্বিয়ান প্রেসিডেন্ট ভুচিচকেও রুট পরিবর্তন করে আজারবাইজানের বাকু হয়ে মস্কো পৌঁছাতে হয়।
সবমিলিয়ে, এবারের বিজয় দিবস প্যারেড শুধু রাশিয়ার যুদ্ধজয়ের স্মরণে নয়, বরং পুতিনের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পুনঃনির্মাণ এবং মিত্রজোটের শক্তি প্রদর্শনের কৌশল হিসেবেই দৃশ্যমান ছিল।