বাংলাদেশ সরকার যখন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছে, ঠিক তখনই শিল্প খাতে গ্যাসের দাম হঠাৎ ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা অতিরিক্ত গ্যাস বিল গুনতে হবে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব প্রচেষ্টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাদের আশঙ্কা, এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে এবং দেশের শিল্প খাতে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, হঠাৎ করে এমন মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে-বিদেশে নেতিবাচক বার্তা যাবে। তিনি মনে করেন, এতে নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবেন এবং শিল্প স্থাপনের গতি থমকে যাবে। তার ভাষায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে আমাদের পণ্যে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক এবং নতুন করে আরও ১০ শতাংশ যুক্ত হয়েছে, সেখানে গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আরও পিছিয়ে দেবে।
অন্যদিকে, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মনে করেন, এই দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগ আরও মজবুত হবে। তিনি বলেন, গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এবং সেই ঘাটতি মেটাতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে, যার মূল্য প্রায় ৭০ টাকা প্রতি ইউনিট। বর্তমানে শিল্পে গ্যাসের দাম ৩০ টাকার মতো হওয়ায় সরকারকে ৪০ টাকার ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাই গ্যাসের দাম বাড়ানোকে তিনি এক ধরনের সিগন্যাল হিসেবে দেখছেন, যাতে উদ্যোক্তারা গ্যাস-সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি এবং বিকল্প জ্বালানির দিকে ঝুঁকেন।
তবে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এতে ভিন্ন মত পোষণ করছেন। হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, একাধিক চ্যালেঞ্জের কারণে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। মার্কিন অতিরিক্ত শুল্ক এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি একসঙ্গে শিল্প খাতকে ধসিয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, ১১ টাকা থেকে ৩০ টাকা করার সময় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। এখন আবার দাম বাড়ানো হলো।
গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে ফাওজুল কবির খান জানান, সরকার এ বিষয়ে কাজ করছে। দেশের গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ২৮০-২৯০ কোটি ঘনফুট। ফলে ১২০ কোটির মতো ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকার চেষ্টা করছে সরবরাহ বাড়িয়ে গ্যাসের চাপ ঠিক রাখতে।
গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের আপত্তি ছিল। তারপরও ১৩ এপ্রিল থেকে নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। নতুন শিল্পে প্রতি ইউনিটে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ ব্যবহারে ৪২ টাকা ধার্য করা হয়েছে। পুরোনো শিল্পে অনুমোদিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহারে নতুন দাম প্রযোজ্য হবে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, পেট্রোবাংলা ১৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও গণশুনানিতে আপত্তির কারণে তা ৩৩ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ভর্তুকির পরিমাণ ও রাজস্ব ঘাটতি বিবেচনায়ও দাম আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে হয়নি বলেও জানান তিনি।
নতুন ও পুরোনো শিল্পে ভিন্ন দাম নির্ধারণ আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসি আইনি কাঠামোর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিনিয়োগ কমে যাবে কি না, সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না বলেও মত দেন তিনি।
এদিকে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নতুন শিল্প তো হবেই না, পুরোনো অনেক কারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্য দেশকে আমদানি নির্ভর করা এবং এলএনজির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল করা। সরকার গ্যাস উৎপাদনে আগ্রহী নয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাসের বর্তমান দামই নতুন শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, তার ওপর আরও দাম বাড়ানো হলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানো স্বাভাবিক।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, খরচ বাড়ানো হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়। গ্যাসের দাম বাড়লেও সরবরাহ নিশ্চিত নয়, যা শিল্পের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় সমস্যা। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এবং ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যু নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে। এই প্রেক্ষাপটে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্প মালিকদের জন্য।