নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়েছে বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

News Desk

নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্কযুদ্ধ। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত অস্বাভাবিক হারে শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন, তবে চীনের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বরং চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক বহাল রেখেই উত্তেজনার পারদ আরও চড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। এরই মধ্যে পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বেইজিং। কখনও যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক চাপিয়ে আঘাত হানছে, আবার কখনও চীন বাড়াচ্ছে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্কের হার। এমন উত্তেজনার মধ্যেই চীন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তাদের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১২.৪ শতাংশ বেড়েছে, যার বড় একটি অংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে।

চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীনে পণ্য রপ্তানি করেছে ১৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের, অথচ একই বছরে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে। এই ঘাটতি কমাতেই চীনের পণ্যের ওপর নজিরবিহীনভাবে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর জবাবে চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত এবং যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম ভাঙছে।

এই শুল্কযুদ্ধের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—চীন কি মার্কিন ঋণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে? আর করলে সেটি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে চীনের হাতে থাকা সবচেয়ে বড় কৌশলগত শক্তি হলো মার্কিন ট্রেজারি বা ঋণ। যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বা ট্রেজারির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধারক চীন, যার হাতে রয়েছে ৭৬ হাজার কোটি ডলারের বন্ড। প্রথম অবস্থানে রয়েছে জাপান, যার দখলে আছে ১ লাখ কোটি ডলারের মার্কিন ট্রেজারি।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিভিন্ন সময়ে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। চীনসহ অনেক দেশ এই বন্ড কিনে যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণ দেয়। কারণ মার্কিন ডলার এখনও বিশ্ববাণিজ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন চাইলে তাদের হাতে থাকা মার্কিন ট্রেজারি কম দামে বাজারে ছেড়ে দিতে পারে। এর ফলে মার্কিন ডলারের মান পড়ে যেতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য এক ধরনের ধাক্কা হয়ে উঠবে।

গ্রাউন্ডওয়ার্ক কলাবরেটিভ নামের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থার পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান অ্যালেক্স জ্যাকেজ জানিয়েছেন, শুল্কের কারণে যখন দুটি দেশ একে অপরের বাজারে প্রবেশ করতে পারে না, তখন প্রতিশোধমূলক কৌশল হিসেবে ট্রেজারি বিক্রি করে ডলারের মান কমানো একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অপ্রত্যাশিত প্রভাব পড়তে পারে।

এ বিষয়ে একমত যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের করনীতি ও হিসাব বিভাগের অধ্যাপক জেমস মোহস। তার মতে, যদি চীন ভবিষ্যতে আরও বেশি মার্কিন ঋণ কিনে এবং পরে তা বিক্রি করে দেয়, তবে তা ডলারের মানকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।

তবে চীন আদৌ এই পথে হাঁটবে কিনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ, এমন পদক্ষেপে চীন নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডলারের মান কমে গেলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মান বেড়ে যেতে পারে, যা চায়নি বেইজিং। ইউয়ানের মূল্য বাড়লে চীনের রপ্তানিপণ্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তাদের অবস্থান দুর্বল করে দেবে।

এছাড়া চীনের হাতে বিপুল পরিমাণ মার্কিন ঋণ থাকায়, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডলারের মানে প্রভাব ফেলতে পারছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি চীন মার্কিন ট্রেজারি কম দামে বিক্রি করে, তবে ফেড আগ্রাসী ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’ নীতির মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ঠিক যেমনটা করা হয়েছিল করোনা মহামারির সময়। তবে বর্তমানে বারবার শুল্ক নীতির পরিবর্তনের কারণে এমন সিদ্ধান্তও এখন অনিশ্চিত।

মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ জানিয়েছে, তারা শিগগিরই সুদের হার কমাবে না। বিনিয়োগ ব্যাংক মরগান স্ট্যানলি পূর্বাভাস দিয়েছে, ফেড চলতি বছরে আর সুদের হারে কোনো পরিবর্তন আনবে না। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা খরচ কমাতে শুরু করেছেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোক্তা আস্থা সূচক অনুযায়ী, এ মাসে ব্যক্তিগত আয় ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগের কারণে ভোক্তাদের আস্থা গত মাসের তুলনায় ১১ শতাংশ কমেছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সব মিলিয়ে শুল্কযুদ্ধ এখন অর্থনৈতিক কৌশলের লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে—যার প্রভাব শুধু এই দুই দেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব অর্থনীতিতে।

Leave a Comment

Footer Section