ঢাকা ইন লাইট ডট কম | ৯ এপ্রিল ২০২৫
দেশে রাবারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় বড় সংকটে পড়েছেন চাষি ও উৎপাদকরা। গত ছয় মাসে প্রতি কেজি রাবারের দাম ২৮০ টাকা থেকে কমে ২২০ টাকায় নেমে এসেছে। এতে শিল্পটি চরম লোকসানের মুখে পড়েছে এবং ক্ষতির শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সহিংসতার কারণে রাবারশিল্প সংকুচিত হচ্ছে। উৎপাদকরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকার যদি এখনই হস্তক্ষেপ না করে, তবে এ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে রাবার রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই আয় ছিল ২৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু দেশীয় বাজারে দাম পড়ে যাওয়ায় চাষিদের আয় আশানুরূপ হয়নি।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক সহিংসতায় গাজী টায়ারের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই কারখানাটি দেশের সবচেয়ে বড় রাবার ক্রেতাদের একটি। অগ্নিকাণ্ডের পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের অর্ডার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। আগের মতো দিনে প্রায় ২৫ টন রাবার আর তারা কিনছে না।
বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে রাবার চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর উৎপাদন হয় ৬৭ হাজার ৯৩৯ টন প্রাকৃতিক রাবার। বেসরকারিভাবে পরিচালিত রাবার বাগানের সংখ্যা ১ হাজার ৩০৪টি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা ২৮টি। এসব বাগানের বেশিরভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। বছরে কাঁচা রাবার বিক্রি হয় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দেশের রাবার খাতে বিনিয়োগ হয়েছে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা এবং এতে কাজের সুযোগ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, বর্তমানে রাবার বাগান পরিচালনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক বাগান মালিক চাইলেও তাদের জমি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, অব্যাহতভাবে এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, রাবারশিল্প রক্ষা, বাজারে স্থিতিশীলতা আনা এবং শ্রমিক ও মালিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এই খাতে রাজস্ব হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।
খাগড়াছড়ি আদিবাসী রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি সমীর দত্ত চাকমা বলেন, জেলার রাবার চাষিরা কখনোই ন্যায্যমূল্য পান না। গত বছর আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার আগ পর্যন্ত রাবারের দাম ছিল প্রতি কেজি ১৮০ টাকা। বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ১২০ টাকায়। এতে ছোট চাষিরা টিকে থাকতে পারছেন না। তার অভিযোগ, মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা করছেন এবং বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে। সীমিত সংখ্যক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা থাকায় প্রতিযোগিতাও নেই।
তিনি জানান, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম হওয়ায় রাবার বাগান অনেক ক্ষেত্রে ফলের বাগানের চেয়ে লাভজনক। খাগড়াছড়ি জেলায় অন্তত ১০০ জন রাবার বাগান মালিক এই খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, গাজী টায়ার তাদের অর্ডার কমিয়ে দেওয়াই বর্তমানে রাবারের দরপতনের অন্যতম কারণ। তবে তিনি আশাবাদী যে, অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে রাবারের চাহিদা আবারও বাড়বে।
তিনি জানান, গাজী টায়ার তাদের কারখানা পুনরায় চালু করলে রাবার কেনা আগের মাত্রায় ফিরে আসবে। গণআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মেঘনা গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান এখনও বাজারে সক্রিয় রয়েছে এবং বাইসাইকেল উৎপাদনে তারা প্রাকৃতিক রাবার ব্যবহার করছে।
বর্তমানে দেশে বড় রাবার ক্রেতার সংখ্যা মাত্র দুটি। এই প্রতিষ্ঠান দুটিই পুরোদমে উৎপাদনে ফিরলে বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গাজী টায়ারের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক বিপণন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা বর্তমানে সীমিত আকারে রাবার প্রক্রিয়াজাত করছেন এবং আগামী আগস্টের মধ্যে পূর্ণ উৎপাদনে ফেরার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, তাদের অর্থায়নকারীরা পুনঃঅর্থায়ন অনুমোদন দিলে সর্বোচ্চ চার মাসের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হবে।