লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার রাতে এক শীর্ষ মিলিশিয়া নেতার হত্যার পর মঙ্গলবার রাতজুড়ে এবং বুধবার সকাল পর্যন্ত চলেছে এই সহিংসতা। এতে শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ত্রিপলির দক্ষিণাঞ্চলের আবু সালিম জেলায় রাতভর গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় মানুষদের অনেকে নিজেদের ঘরে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন, অনেকের গাড়ি ও সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের লিবিয়া মিশন (UNSMIL) এই সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, “ত্রিপলির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সহিংসতা যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।”
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের নতুন ইঙ্গিত
সর্বশেষ এই সংঘর্ষ লিবিয়ার জাতীয় ঐক্য সরকারের (GNU) প্রধানমন্ত্রী আবদুলহামিদ আল-দ্বেইবাহর (Abdulhamid al-Dbeibah) ক্ষমতা আরও সুসংহত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তুরস্কের ঘনিষ্ঠ মিত্র দ্বেইবাহ মঙ্গলবার ‘অবৈধ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর’ বিলুপ্তির নির্দেশ দেন। এর মাধ্যমে তিনি ত্রিপলির শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়করণের পথে এগোচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই নির্দেশ আসে একদিন আগে নিহত মিলিশিয়া নেতা আবদুলঘানি কিকলির (যিনি ‘ঘানিওয়া’ নামে পরিচিত) মৃত্যুর পরপরই। কিকলির নেতৃত্বাধীন ‘স্ট্যাবিলাইজেশন সাপোর্ট অ্যাপারেটাস’ (SSA) হঠাৎ করেই পরাজিত হয় দ্বেইবাহঘনিষ্ঠ ৪৪৪ ও ১১১ ব্রিগেডের হাতে। এর ফলে SSA-এর নিয়ন্ত্রিত এলাকা দ্বেইবাহপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দখলে চলে যায়।
ত্রিপলির বৃহত্তম ও সুসংগঠিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল SSA। এখন শুধুমাত্র ‘স্পেশাল ডিটারেন্স ফোর্স’ (রাদা) অন্যতম বড় শক্তি হিসেবে টিকে আছে, যারা এখনও দ্বেইবাহর সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ
২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়া চরম অস্থিরতায় পড়ে। ২০১৪ সাল থেকে দেশটি পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেখানে পূর্বাঞ্চলে কমান্ডার খলিফা হাফতারের নেতৃত্বে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (LNA) এবং পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার করে। ২০২০ সালে একটি যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে বড় আকারের সংঘর্ষ কিছুটা কমলেও দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি।
লিবিয়া একটি প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ এবং ইউরোপগামী অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পথ। এর ভেতরকার সংঘর্ষে তুরস্ক, রাশিয়া, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি জড়িয়ে পড়েছে। যদিও তেলের প্রধান কেন্দ্রগুলো দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে, বর্তমান সংঘর্ষ প্রধানত ত্রিপলিকে ঘিরেই।
স্থানীয় মানুষদের আতঙ্ক ও দুর্ভোগ
ত্রিপলির বাসিন্দারা জানান, রাতভর গোলাগুলির কারণে তাঁরা ঘুমাতে পারেননি। শহরের একাধিক এলাকায় দোকানপাট বন্ধ, স্কুল-কলেজ স্থগিত এবং রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে পড়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাড়ি ও ভবনগুলোর পাশে আতঙ্কিত মানুষজনকে বসে থাকতে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বেইবাহর প্রতি অনুগত মিলিশিয়ারা রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করলে, তা নতুন করে লিবিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। তবে রাদার মতো শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে ভবিষ্যতে সংঘর্ষ আরও বাড়বে কি না তার ওপর।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই উত্তেজনা প্রশমনে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে লিবিয়া আবারও বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পথে ফিরে যেতে পারে বলে সতর্ক করছেন পর্যবেক্ষকরা।