৭ মে দিবাগত রাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সীমান্ত উত্তেজনা শুধু সামরিক স্তরেই সীমাবদ্ধ নেই—এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আরেকটি যুদ্ধ, আর তা হলো তথ্য নিয়ে লড়াই। দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি দাবি করে চলেছে, যেগুলোর সত্যতা যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার সীমারেখা যেন আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
ভারত দাবি করেছে, তারা পেহেলগামে সম্প্রতি সংঘটিত প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে নয়টি ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছে, যেখানে ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রমাণ চেয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান বলছে, ভারতের এই হামলায় অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ছিল তিন বছরের এক শিশু। পাকিস্তান দাবি করছে, ভারতের বাহিনী ছয়টি শহর এবং একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। তবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পাল্টা দাবি করে বলেছেন, ভারতীয় বাহিনী কোনো বেসামরিক নাগরিককে লক্ষ্য করেনি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং এই হামলাকে ‘সুনির্দিষ্ট’ এবং ‘কম ক্ষতির’ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তবে সংঘর্ষ শুধু গোলাবারুদে সীমাবদ্ধ নয়। তথ্যের এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় সেনারা সাদা পতাকা তুলেছে, যা আত্মসমর্পণের প্রতীক। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী এই দাবির পক্ষে বলেন, ‘তারা তদন্ত থেকে যেমন পালিয়েছে, এবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও পালিয়েছে।’ যদিও ভারত সরকার এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
এছাড়া পাকিস্তান দাবি করেছে, পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভারতীয় ভূখণ্ডেই ভূপাতিত হয়েছে। তবে কোন পক্ষ কার বিমান ভূপাতিত করেছে বা আসলেই বিমানগুলো কার, তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা সূত্র বলছে, তিনটি যুদ্ধবিমান ভারতনিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভূপাতিত হয়েছে, তবে তারা স্পষ্ট করেনি সেগুলো ভারতীয় না পাকিস্তানি। অন্যদিকে চীনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত রিপোর্টে এই দাবিকে ‘মিথ্যা তথ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই পরস্পরবিরোধী তথ্যের যুদ্ধ নতুন নয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর ভারত বালাকোটে বড় ধরনের বিমান হামলা চালায় বলে দাবি করে। তখনও পাকিস্তান বলেছিল, হামলাটি জনমানবহীন এলাকায় পড়েছিল এবং তারা কোনো ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। একইভাবে ২০১৬ সালে উরির সেনাঘাঁটিতে হামলার পর ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি করে, যেটিকে পাকিস্তান ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দেয়।
তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও প্রচারের এই লড়াই এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক মাধিহা আফজাল বলেন, ৭৭ বছরের পুরোনো ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে তথ্য নিয়ন্ত্রণ এখন উভয় পক্ষের জন্য বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিকাশ এই তথ্যযুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলেছে। যদিও এতে তথ্য যাচাই সহজ হয়েছে, তবুও উভয় দেশের সরকারি মিডিয়া কর্তৃপক্ষের প্রভাবে বিভ্রান্তিকর প্রচার এখনো বাস্তবতা।
অবশ্য দুই দেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম অনেক সময় সরকারের পছন্দসই বয়ান অনুসরণ করে, যার ফলে সরকার জনমত নিয়ন্ত্রণে সুবিধা পায় এবং নিজেদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ার চেষ্টা চালায়।
এই যুদ্ধের ছায়া কেবল সীমান্তে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জনমনে, মিডিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও। তথ্য নিয়ন্ত্রণের এই প্রতিযোগিতায় সত্যকে খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।