চীন এবার মহাকাশ গবেষণায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম সিচুয়ান প্রদেশের শিচ্যাং স্যাটেলাইট লঞ্চ সেন্টার থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হলো তিয়েনওয়েন-২ মহাকাশযান। এটি দুটি এমন মহাজাগতিক বস্তুর দিকে যাত্রা শুরু করেছে, যেগুলো আগে কখনো কোনো মহাকাশযানের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে অন্বেষিত হয়নি।
চীনের এই নতুন মিশনের প্রথম লক্ষ্য হলো ‘কামোওয়ালেওয়া’ নামের একটি ক্ষুদ্র গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করা। এই গ্রহাণুটিকে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, এটি চাঁদেরই একটি অংশ, যেটি কোনো সংঘর্ষে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর নিকটে কক্ষপথে ঘুরছে। একে বলা হয় ‘কোয়াসি স্যাটেলাইট’।
তিয়েনওয়েন-২ মহাকাশযান এক বছর ধরে কামোওয়ালেওয়ার দিকে যাত্রা করবে এবং এরপর আরও এক বছর সেটিকে প্রদক্ষিণ করে সম্ভাব্য অবতরণস্থল নির্ধারণ করবে। অবশেষে একটি ক্যাপসুলে সেই নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে, যা সময় লাগবে প্রায় আড়াই বছর।
নমুনা সংগ্রহের পর এই মিশন আরও সাত বছর সময় নিয়ে যাত্রা করবে ‘৩১১পি/প্যান-স্টারস’ নামের একটি মূল বেল্ট ধূমকেতুর দিকে। এই বস্তুটি গ্রহাণু বেল্টে অবস্থান করে কিন্তু ধূমকেতুর মতো ধুলিভরা লেজ তৈরি করে, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাকটিভ অ্যাস্টেরয়েড’ বা সক্রিয় গ্রহাণু বলছেন।
তিয়েনওয়েন-২ মিশনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, কামোওয়ালেওয়া হবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে ছোট গ্রহাণু যেটিতে কোনো মহাকাশযান নমুনা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। এর ব্যাস মাত্র ৪৬ থেকে ৫৮ মিটার, যা তুলনামূলকভাবে ‘ফেরিস হুইল’-এর আকৃতির সমান। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৯০ লাখ মাইল দূরত্বে অবস্থান করে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, কামোওয়ালেওয়া যদি সত্যিই চাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে এটি আমাদের চন্দ্রপৃষ্ঠ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করতে পারবে। অন্যদিকে যদি এটি চাঁদের মতোই কেবল আলোক প্রতিফলন করে, তবে সেই রহস্য উন্মোচনের কাজেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে ৩১১পি/প্যান-স্টারস নামক ধূমকেতু আকৃতির গ্রহাণুটি বিজ্ঞানীদের কাছে আরও এক বিস্ময়। এটি গ্রহাণু বেল্টে থাকা সত্ত্বেও ধুলির লেজ তৈরি করে, যা আগে মনে করা হতো শুধুমাত্র বরফঘেরা ধূমকেতুগুলোই করতে পারে। কেন এটি ধূলিকণা নির্গত করছে, তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। হয়তো অভ্যন্তরীণ চাপ বা কোনো সংঘর্ষের ফলে এই ধূলিকণা বেরিয়ে আসছে।
এই গ্রহাণুর পৃষ্ঠে ভ্রমণ করলে বিজ্ঞানীরা সরাসরি দেখতে পাবেন এর কার্যকারণ, যা এখনো কেবল কল্পনার জগতে রয়ে গেছে।
এই দুটি বস্তু গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, সৌরজগতের গঠন এবং পৃথিবীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ঝুঁকি সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে কামোওয়ালেওয়ার মতো বস্তু পৃথিবীতে আঘাত হানলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তার একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। কারণ কামোওয়ালেওয়া আকারে প্রায় ১৯০ ফুট, যা ১৯০৮ সালে রাশিয়ার টুংগুস্কা অঞ্চলে আঘাত হানা গ্রহাণুর কাছাকাছি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অভিযানের মাধ্যমে অভূতপূর্ব তথ্য মিলবে, যেগুলো ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণায় অভূতপূর্ব দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এখন পর্যন্ত কোনো মহাকাশযান তার লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে বড় কোনো চমক ছাড়াই ফিরেছে—এমন ঘটনা বিরল।
তিয়েনওয়েন-২ চীনের বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার আরেকটি নজির, যা শুধু তাদের মহাকাশ অন্বেষণ নয়, বরং পুরো মানবজাতির মহাবিশ্ব বুঝে ওঠার যাত্রাকে এগিয়ে নেবে আরও এক ধাপ।