গ্রীষ্মের তাপদাহে জর্জরিত ইউরোপের সবচেয়ে গরম শহর এথেন্স, পর্যটকদের জন্য প্রস্তুতির লড়াই

News Desk

গ্রীষ্মের তাপদাহে জর্জরিত ইউরোপের সবচেয়ে গরম শহর এথেন্স, পর্যটকদের জন্য প্রস্তুতির লড়াই. Dhakainlight.com

এথেন্সের প্রাচীন সভ্যতার প্রতীক অ্যাক্রোপলিসে উঠা সব সময়ই ছিল এক চ্যালেঞ্জ, তবে সাম্প্রতিক গ্রীষ্মগুলোতে তা হয়ে উঠেছে একপ্রকার সহ্যশক্তির পরীক্ষা। একের পর এক তীব্র তাপপ্রবাহে গত দুই বছরে গ্রীষ্ম মৌসুমে দিনের সবচেয়ে গরম সময়গুলোতে অ্যাক্রোপলিস বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়া তাপমাত্রায় নিরাপত্তার স্বার্থেই নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।

গ্রিসের জাতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর জুলাই ও আগস্টে এথেন্সের তাপমাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেই শহরটিতে ১ কোটির বেশি পর্যটক আগমনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে, যা একদিকে যেমন অর্থনীতিকে চাঙা করবে, অন্যদিকে জল, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সংকটকে তীব্রতর করে তুলবে।

সংকটের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে টেকসই পর্যটন নিয়ে। দেশজুড়ে বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের একাংশ মনে করছেন, ‘সর্বোচ্চ পর্যটনের’ লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় গ্রিকদের নিজস্ব বসবাসযোগ্যতা, পরিবেশ এবং মৌলিক অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

তবে হতাশার মাঝেও উদ্যমের অভাব নেই। এথেন্সের মেয়র হারিস ডুকাসের মতে, “জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা এখন টিকে থাকার বিষয়।” শহরে শীতল স্থান, ছায়াযুক্ত পার্ক, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্র, তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ ও সতর্কবার্তা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি জরুরি সেবা প্রস্তুত রাখা হয়েছে, বিশেষ করে অ্যাক্রোপলিসের আশেপাশে।

তাপপ্রবাহে ঝুঁকিতে থাকা শহরটিকে দীর্ঘমেয়াদে সহনশীল করে তুলতে ৭,০০০ গাছ ইতোমধ্যে রোপণ করা হয়েছে, এবং ২০২৯ সালের মধ্যে ২৮,০০০ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে মাইক্রোফরেস্ট বা ক্ষুদ্র বন এবং সবুজ করিডোর। লক্ষ্য, আগামী পাঁচ বছরে ‘অনুভূত’ তাপমাত্রা কমিয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আনা।

বিশেষ করে কিপসেলি এলাকায়, ইউরোপের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, গ্রীসের প্রথম মাইক্রোফরেস্ট গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রাচীন রোমান যুগের জলপ্রবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে আজকের সবুজায়নকে সহায়তা করতে চালু করা হচ্ছে পুনর্ব্যবহৃত জল সঞ্চালন ব্যবস্থা।

শহরের অতীত আর বর্তমানকে যুক্ত করার প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যাথেন্স রিভিয়েরা। এটি মূলত পুরনো এলিনিকন বিমানবন্দরের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ৬০০ একরের এক বৃহৎ উপকূলীয় উদ্যান এবং আবাসন প্রকল্প। এখানে গড়ে উঠবে গ্রীসের প্রথম স্কাইস্ক্র্যাপার রিভিয়েরা টাওয়ার এবং এক মিলিয়ন পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে নির্মিত হচ্ছে এলিনিকন মেট্রোপলিটন পার্ক, যা হবে শহরের সবচেয়ে বড় সবুজ এলাকা।

তবে এই উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোর সঙ্গে রয়েছে সামাজিক চাপও। পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির কারণে স্থানীয়রা তাদের বসতভিটা হারাচ্ছেন, সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং অনেক অঞ্চল ধনীদের অভিজাত এলাকাতে পরিণত হচ্ছে। এমনকি পর্যটকদের জন্য নির্মিত হোটেল ও সুইমিং পুলগুলো বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এদিকে বন্যাগ্রস্ত এলাকা, বিশেষ করে রাজধানী ঘিরে থাকা বনাঞ্চলের ৪০ শতাংশ এরই মধ্যে দাবানলে পুড়ে গেছে। ফলাফল, একদিকে পানির সংকট, অন্যদিকে বায়ুদূষণ এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস—সব মিলিয়ে বসবাসযোগ্যতা কমে যাচ্ছে।

তবু থেমে নেই পর্যটকদের আগমন। ২০২৪ সালে ৩৬ মিলিয়ন পর্যটক এসেছেন গ্রীসে, যা দেশটির জনসংখ্যার তিন গুণ। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৪০ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ফিচ সল্যুশনস।

গাইড ইরিস প্লাইটাকিস বলেন, “মানুষ বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে আসেন এথেন্সে—প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে, অলিম্পিকের জন্মস্থান দেখতে। এই অভিজ্ঞতা অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।”

তবে এই প্রবাহকে একটু ছড়িয়ে দিতে চান নগর পরিকল্পনাবিদরা। গ্রীষ্ম ছাড়াও বসন্ত, শরৎ এবং এখন শীতকালেও এথেন্স হয়ে উঠছে জনপ্রিয় গন্তব্য। আর তারই অংশ হিসেবে পর্যটকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে দুপুরের রোদ এড়িয়ে অ্যাক্রোপলিস মিউজিয়াম, ন্যাশনাল আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম এবং সাইক্লাডিক আর্ট মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে।

অথবা শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্ট্যাভরোস নিয়ারকোস ফাউন্ডেশন কালচারাল সেন্টার থেকে শুরু করে সুন্দর গ্রিক সৈকত হয়ে পোসেইডনের মন্দির পর্যন্ত ভ্রমণ করা যেতে পারে, যেখানে সূর্যাস্ত দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

রাত নামলেই শহর আবার জেগে ওঠে। খোলা আকাশের নিচে সিনেমা, সঙ্গীতানুষ্ঠান আর নাইটলাইফ এথেন্সের সংস্কৃতির অংশ। আর এখানেই গ্রীকদের জলবায়ু অভিযোজনের এক অনন্য রূপ—গ্রীষ্মের গরম এড়িয়ে রাতের ঠান্ডায় জীবনের আনন্দ খোঁজা। এটাই যেন নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর তাদের প্রাকৃতিক উত্তর।

Footer Section