লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরাঞ্চলে খেতে পেকে গেছে সয়াবিন। কিন্তু ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকেরা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বিএনপি নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা কৃষকদের ফসল কাটতে নিষেধ করছেন, এমনকি চাঁদাও দাবি করছেন। এতে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চরের শত শত প্রান্তিক কৃষক।
মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চর কাছিয়া, চর ঘাসিয়া, চর কানিবগা, চর জালিয়া, টুনির চর ও চর ইন্দুরিয়াসহ অন্তত ছয়টি চরজুড়ে মাঠভরা পাকা সয়াবিন পড়ে রয়েছে। কৃষকেরা জানান, তাঁরা ধারদেনা করে জমিতে সয়াবিন চাষ করেছেন। কিন্তু বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা ভয়ভীতি ও চাঁদার দাবিতে তাঁদের ফসল কাটতে দিচ্ছেন না।
চর কাছিয়া গ্রামের কৃষক আরিফুর রহমান জানান, তিনি ছয় বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষ করেছেন। ফসল পেকে গেছে, কাটা দরকার দুই-তিন দিনের মধ্যে। কিন্তু স্থানীয় যুবদল নেতা আমিনুল আজিজ ও বিএনপি নেতা হারুনুর রশিদ হওলাদারের লোকজন তাঁকে সয়াবিন কাটতে নিষেধ করেছেন।
চর ঘাসিয়ার কৃষক রফিজ সরদার জানান, একরপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে অনেক কৃষক ফসল কাটার অনুমতি পেয়েছেন। এই অনুমতি দিয়েছেন মেহেদী কবিরাজ ও জি এম শামীম গাজীর অনুসারীরা। অনেকে চাঁদা দিতে না পেরে ভয়ে ফসল কাটছেন না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগে এই জমিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের হাতে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর এখন বিএনপির কিছু নেতা সেই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। জমির প্রকৃত মালিকানা সরকারের হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির নেতারা তা নিজেদের আয়ত্তে রেখেছেন এবং চাষাবাদ করতে দেওয়া হচ্ছে টাকা নিয়ে।
গত ১৭ এপ্রিল রায়পুর উপজেলার উত্তর চর বংশী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে উপজেলা প্রশাসন একটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করে। সেখানে অন্তত ১১ জন কৃষক ফসল কাটতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনেন এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান। সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি), রায়পুর থানার ওসি এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, জমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে চলতি বছর ৭ এপ্রিল সংঘর্ষ হয়। এতে দুজন নিহত হন। নিহতরা হলেন জসিম উদ্দিন ব্যাপারী (৩৮) ও সাইজুদ্দিন দেওয়ান (৪০)। তাঁরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন। সংঘর্ষের পেছনে ভূমি নিয়ন্ত্রণ ও ফসল চাষের আধিপত্য ছিল বলে জানা যায়।
যুবদল সভাপতি আমিনুল আজিজ ও বিএনপি নেতা হারুনুর রশিদ হওলাদার বলেন, আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২০ শতাংশ জমি ফেলে তাঁরা চলে গেছেন। এখন তা নির্যাতিত বিএনপি নেতাদের চাষের জন্য দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা দাবি করেন, একরপ্রতি চাঁদার অভিযোগ সত্য নয়।
এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফসল যিনি আবাদ করেছেন, তিনিই তার মালিক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান খান জানান, “কৃষকই তার ফসল ঘরে তুলবেন, এতে কোনো বাধা দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, চরের ৬০০-৭০০ একর জমি সরকারের মালিকানাধীন। কিছু জমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া হলেও অধিকাংশ এখনো প্রভাবশালীদের দখলে। এসব দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
রায়পুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। সম্ভাব্য উৎপাদন ৩০ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩২০-৩৫০ কোটি টাকা। লক্ষ্মীপুর জেলায় এ বছর মোট উৎপাদনের সম্ভাবনা ৮৪ হাজার মেট্রিক টন।
এই সয়াবিন দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল ও পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ হয়। অথচ চাষিরা নিজের ঘামঝরা ফসল ঘরে তুলতে না পেরে এখন জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।