আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। আগামী মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড় পাওয়ার কথা থাকলেও শর্ত পালনের বিষয়টি এখনো সমঝোতায় পৌঁছায়নি। মূল বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে—বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
বাংলাদেশ এখনো আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বিনিময়হার ব্যবস্থায় রয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে, কিন্তু আইএমএফ চায় সম্পূর্ণভাবে বাজারনির্ভর বিনিময়হার চালু করতে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই একটি শর্ত পূরণ না হওয়ায় কিস্তি ছাড় আটকে আছে।
২০২২ সাল থেকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাম ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। এখনো ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে। অথচ বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বিনিময়হার নির্ধারণ করলে তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্মুক্ত বিনিময়হার চালুর জন্য তুলনামূলক অনুকূল। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম ও জ্বালানির মূল্য কমছে, আমদানির চাপও নিয়ন্ত্রিত। তা ছাড়া বাজেট ও প্রকল্প সহায়তাও নিয়মিত আসছে। এসব বিবেচনায় বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন মনে করেন, “এখন না করলে কবে? এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে উপযুক্ত।”
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় শঙ্কায় রয়েছে যে, বিনিময়হার পুরোপুরি উন্মুক্ত করলে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। তাই তারা বিকল্প হিসেবে আইএমএফের কাছে একটি ‘স্থিতিশীলতা তহবিল’ (Stabilization Fund) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে আইএমএফ ১০০ কোটি ডলারের একটি সুরক্ষা তহবিল দিলে বাংলাদেশ বিনিময়হার উন্মুক্ত করতে প্রস্তুত।
বর্তমানে বাংলাদেশ আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচিতে আছে, যার মধ্যে ৩ কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে। বাকি রয়েছে ২৩৯ কোটি ডলার। এ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় কিছুটা ছাড় দিয়েছে আইএমএফ। শুরুতে ৫৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের শর্ত থাকলেও এখন তা কমিয়ে ৪৫৫ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।
তবে বিনিময়হার ইস্যু এখনো অমীমাংসিত। আইএমএফ চাইছে বাজারনির্ভর বিনিময় হার, আর বাংলাদেশ চাইছে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা নমনীয়তা। আলোচনা চলছে, কিন্তু সমঝোতা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে ঋণ কর্মসূচি স্থগিত হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক আর্থিক পরিমণ্ডলে। ঋণমানকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রেটিং কমিয়ে দিতে পারে, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। এমনকি বিশ্বব্যাংক ও এডিবির বাজেট সহায়তাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত, করব্যবস্থা ও ব্যয় ব্যবস্থাপনার মতো দীর্ঘদিনের সংস্কারগুলো আইএমএফের কর্মসূচির আওতায় বাস্তবায়ন সহজ হয়। কর্মসূচি স্থগিত হলে সেই সুযোগও হারাতে পারে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করাই হবে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সরকারের।