ঢাকা ইন লাইট ডট কম ডেস্ক রিপোর্ট
বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক বৈশ্বিক ও দেশীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে হাঁটছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, ঋণের সুদের উচ্চ হার ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মাঝেও অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি)-এর সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, সবচেয়ে খারাপ সময়টা হয়তো কেটে গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ও রিজার্ভ স্থিতিশীল হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বাস্তবতায় খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন।”
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবং ক্রেতাদের আস্থা ফিরলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আরও গতি পাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে উৎপাদন খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেছে। এর পেছনে মূল্যস্ফীতি, আমদানি নির্ভরতা, ঋণের উচ্চ সুদ হার এবং টাকার মূল্যহ্রাসের প্রভাব রয়েছে। “অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়লেও খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমেছে। মূল্যস্ফীতি বড় কারণ। টাকার দাম পড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে, অথচ সব প্রতিষ্ঠান সেই ব্যয় গ্রাহকদের ওপর চাপাতে পারেনি,” বলেন রূপালী চৌধুরী।
২০২৩ ও ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ পরিকল্পনা স্থগিত করে। এলসি (ঋণপত্র) খোলায় বিধিনিষেধ এবং সুদের হার বেড়ে যাওয়ার ফলে খরচ বেড়েছে। বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি চাপে পড়েছে। “ঋণের সুদের বাড়তি খরচ ও এলসি খোলার সময়ের জটিলতা অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিক সংকট তৈরি করেছে। এদিকে ব্যাংকগুলো উল্টো লাভবান হয়েছে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “ক্রেতাদের আস্থা কম থাকায় বাজারে চাহিদা কমে গেছে। বিশেষ করে নির্মাণখাতে মন্দার প্রভাব ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পে পড়েছে। তবে এফএমসিজি খাতে মিশ্র ফলাফল দেখা গেছে।”
সবকিছু সত্ত্বেও তিনি আশাবাদী। “গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে চাঙ্গাভাব দেখা গেছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে, রপ্তানি খাতেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তবে পোশাক খাতে কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ায় কিছুটা চাপ আছে।”
রূপালী চৌধুরী বলেন, “ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দামও কমছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে সরকারকে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুঁজিবাজারে আয় নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগ বাড়বে।”
তিনি বলেন, “ভালো মানের প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী নয়, কারণ কমপ্লায়েন্স খরচ বেশি। প্রণোদনা থাকলে ও নিয়মনীতি সহজ হলে অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হবে।”
বিএপিএলসি সরকারের গঠিত টাস্কফোর্সে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। করপোরেট কর ব্যবধান কমেছে, তবে আরও প্রণোদনার প্রয়োজন। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে সহজতর পদ্ধতি ও আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। হঠাৎ কর-শুল্ক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে স্থিতিশীল ও অনুমানযোগ্য রাজস্বনীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন রূপালী চৌধুরী।
তিনি বলেন, “সরকার এফডিআই আনতে কাজ করছে, যা প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়াবে। কোরিয়ান ইপিজেডের সমস্যা সমাধান ইতিবাচক সংকেত।”
আমদানি শুল্কের হিসাবেও অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে এনবিআরকে আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী তথ্য হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, “বর্তমানে কিছু শুল্ক নির্দিষ্ট কোডের পরিবর্তে ভিন্ন কোডের অধীনে গণনা করা হয়, ফলে ব্যবসায়ীদের উচ্চহারে আমদানি শুল্ক দিতে হয়। এই সমস্যা সংশোধন করা হলে কেবল খরচ কমবে না, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও কমবে।”
তিনি মনে করেন, চলতি বছরে সংকট থাকলেও সম্ভাবনার জায়গাও রয়েছে। “সুদের হার বেশি থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ক্রেতাদের খরচ বাড়াতে হবে। ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কাজের সুযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
তিনি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “খেলাপি ঋণ এখনো উদ্বেগের বিষয়। অনেক প্রতিষ্ঠান টাকার জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে সরকার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনছে।”
তিনি বলেন, “আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ডলারের বিনিময় হার ও রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকলে ধীরে ধীরে হলেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।”