দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দলটি এখন আবার রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ এখন মাস্টারপ্ল্যান সাজাচ্ছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে আবারও রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা এবং ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থেকে যাওয়া।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। মিছিলগুলো শুরুর দিকে ছোট হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। গোপনে সমাবেশের প্রস্তুতি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি এবং মাঠ পর্যায়ে সংগঠনের পুনঃগঠন—সব মিলিয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে যে, আওয়ামী লীগ আবারও তাদের পুরোনো রূপে ফিরে আসার চেষ্টায় ব্যস্ত।
তবে এই সক্রিয়তা ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এত বড় গণজাগরণ এবং রক্তাক্ত ঘটনার পর প্রশাসনের ভেতর থেকে কোনো ধরনের সবুজ সংকেত বা সহযোগিতা ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজপথে এভাবে ফেরত আসা সম্ভব নয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রশাসনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা কৌশলে দলটিকে সহায়তা দিচ্ছেন। এ ছাড়াও শোনা যাচ্ছে, কোনো কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি এবং দেশের একটি মহল আওয়ামী লীগকে আবারও সামনে নিয়ে আসার পরিকল্পনায় আছে, যাতে তৃতীয় কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে না পারে।
রাজনীতিতে একটি নতুন চালও লক্ষ্য করা যাচ্ছে—আওয়ামী লীগকে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসানোর পরিকল্পনা চলছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে আগামীতে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও জটিল হতে পারে। তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে জুলাই মাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক মামলায় রূপ নিতে পারে এবং অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যেতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করেন, “যেদিন থেকে আমাদের আওয়ামীবিরোধী অবস্থান এবং কম্প্রোমাইজের রাজনীতির বিরোধিতাকে ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ বলা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের মিছিল বড় হতে শুরু করেছে।” তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “অতি শিগগিরই আওয়ামী লীগ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসুন, না হলে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ শুরু করতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ আবারও সক্রিয় হওয়ার সাহস পাচ্ছে। দেশি-বিদেশি কিছু প্রভাবশালী শক্তি দলটিকে উৎসাহ দিচ্ছে, যার ফলে রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
গত এক সপ্তাহেই রাজধানীতে অন্তত চারটি ঝটিকা মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ শুক্রবার উত্তরায় অনুষ্ঠিত মিছিলে বেশ বড়সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা গেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারও এখন সতর্ক অবস্থানে। গোপন অভিযানে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, পুলিশকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—আওয়ামী লীগের যেকোনো ধরনের মিছিল কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তিনি বলেন, “পুলিশ ইতোমধ্যে দুজনকে আটক করেছে।”
এ বিষয়ে সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, “আমি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, কিন্তু যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত।” অন্যদিকে, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেছেন, “ফ্যাসিজম যেন বাংলাদেশে আর কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা জরুরি।”
রাজনীতির এই উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন উদ্বেগ বাড়ছে, তেমনি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন—সতর্ক না হলে পুরোনো ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসতে পারে।