অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত যুবক সাগরের কান্না: দুধ দিয়ে গোসল করে বললেন, ‘কোনো দিন এই জুয়ো খেলব না’

News Desk

অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত যুবক সাগরের কান্না: দুধ দিয়ে গোসল করে বললেন, ‘কোনো দিন এই জুয়ো খেলব না’, Dhakainlight.com

এক সময় দামি মোটরসাইকেলে চড়া এক তরুণ ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। নিজ হাতে গড়া ছিল আধা পাকা বাড়ি, একটি শোরুম, ব্যবসায়িক পরিচিতি—সব মিলিয়ে প্রায় ৩৬ লাখ টাকার সম্পদ। অথচ মাত্র এক বছরের ভুলে, এক ধ্বংসাত্মক আসক্তিতে—সব হারালেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সাগর হোসেন। অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর ফাঁদে পড়ে এখন শুধু খালি হাতে নয়, হৃদয় ভাঙা যন্ত্রণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সমাজের সামনে। আর বলতে শোনা যাচ্ছে—“এই জুয়ো খেলব না, খেলব না, খেলব না।”

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কুমারখালীর পান্টি ইউনিয়নের গোলাবাড়ি বাজারে ঘটে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য। অসংখ্য মানুষের সামনে দুধ দিয়ে গোসল করলেন সাগর হোসেন। শুধু গোসল নয়, মুখে উচ্চারিত হতে থাকল তীব্র অনুশোচনার কথা, আত্মপ্রকাশের আকুতি, এবং এক আত্মসমর্পণের প্রতিজ্ঞা। স্থানীয়দের সহযোগিতায় দুধ ঢেলে দেওয়া হয় তাঁর মাথায়, আর সেই মুহূর্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে রাতেই। মাত্র ১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও হয়ে যায় ভাইরাল।

ভিডিওতে সাগরের কণ্ঠে শোনা যায়:

“আমার ছিল বিলাসী জীবন। পান্টিতে একটা মোটরসাইকেলের শোরুম ছিল। খুব শখ করে একটা বাড়ি করেছিলাম। মোবাইলে জুয়া খেলে শোরুম গেছে, বাড়ি গেছে। আমার এই দৃশ্য দেখে যদি অন্তত একজন মানুষও শিক্ষা নেয়, আমি ধন্য হবো। আমি শপথ নিচ্ছি—জীবনে আর কোনো দিন এই জুয়ো খেলব না।”

একসময় মাসে ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করতেন তিনি। ব্যবসা করতেন সততার সঙ্গে। প্রথমে কাপড়ের ব্যবসা, পরে পুরোনো মোটরসাইকেলের শোরুম। সৎভাবে উপার্জিত সেই অর্থে গড়ে তুলেছিলেন স্বপ্নের বাসস্থান, ব্যবসার আস্থার জায়গা। কিন্তু অনলাইন জুয়া নামক ডিজিটাল সর্বনাশ তাকে টেনে নিয়ে যায় এক ভয়ংকর গভীরে। একের পর এক খেলায় হারতে হারতে সবকিছু বিক্রি করে দিতে হয়। শেষমেশ বাড়ি বিক্রি করেন ২১ লাখ টাকায়, শোরুম ১৫ লাখে। তবু দেনা শোধ হয়নি, এখনো সাড়ে তিন লাখ টাকা দেনার বোঝা রয়ে গেছে।

এই সর্বনাশা অভিজ্ঞতা যখন আর সহ্য হচ্ছিল না, তখন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাগর। কিন্তু স্থানীয়রা বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত তাঁকে বোঝান এবং পরামর্শ দেন একটি সামাজিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বার্তা দিতে। তখনই সিদ্ধান্ত হয় জনসমক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার। যাতে এই গোসল শুধুই প্রতীক না হয়ে ওঠে—একটি শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের জন্য।

সাগরের বক্তব্যে উঠে আসে সমাজে অনলাইন জুয়ার ব্যাপক বিস্তারের বাস্তবতাও। তাঁর ভাষায়, “এই পান্টি বাজারেই অনেক মানুষ মোবাইলে জুয়া খেলেন। আমি নিজের সম্মান ভুলে এই কাজ করেছি যেন কেউ শিক্ষা নেয়।”

সাগরের স্ত্রী কনা খাতুন বলেন, “সবকিছু—বাড়ি, গহনা, আসবাব, মোটরসাইকেল—সব গেছে। এখন অন্যের বাড়িতে থাকলেও, সেই বাড়িটি এক সময় আমাদের ছিল। আমার অনুরোধ, আর কারও যেন এমন না হয়।”

এই প্রতিবেদন শুধুই একটি ব্যক্তির ব্যর্থতা নয়, বরং সমাজের এক ভয়ংকর প্রবণতার বাস্তব প্রতিফলন। যেখানে মোবাইল নামক প্রযুক্তি জীবন সহজ করতে এসেছিল, সেখানে এক অংশ মানুষ তা ব্যবহার করছে ধ্বংসের পথে। অনলাইন জুয়া এখন একটি নীরব মহামারি। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে এর প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

সাগর হোসেনের মতো কেউ কেউ হয়তো নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষার বার্তা দিতে চান। কিন্তু সমাজকে এখনই জেগে উঠতে হবে—আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পরিবার, বিদ্যালয়, গণমাধ্যম—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে।

Leave a Comment

Footer Section