বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের অপটিক্যাল ফাইবার কেব্লের ইজারা মূল্য বাড়িয়েছে, যা দেশের ইন্টারনেট সেবায় নতুন চাপ তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অপারেটররা। রেলওয়ের নতুন দরপত্র অনুযায়ী, প্রতি কোর ফাইবারের দাম ৪ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল ৩ টাকা ৮ পয়সা। এতে জোড়া কোর ফাইবারের ভাড়া দাঁড়াচ্ছে ৯ টাকা—পূর্বের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (টেলিকম) সুশীল কুমার হালদার জানিয়েছেন, ফাইবারের মান উন্নত হওয়ায় মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অপারেটরদের অভিযোগ, এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) অনুমোদন ছাড়া করা হয়েছে, যা নীতিমালার লঙ্ঘন। বিটিআরসির কোনো অনুমোদন ছাড়াই রেলওয়ে দাম বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
রেলওয়ের প্রায় ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফাইবার কেব্ল দেশের মোবাইল ও এনটিটিএন অপারেটররা ইজারা নিয়ে ব্যবহার করে আসছে। এই ফাইবারের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরসহ বিভিন্ন সংস্থা গ্রাহকদের ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। প্রতি পাঁচ বছর পরপর ইজারা নবায়নের সময়ই রেলওয়ে মূল্য হালনাগাদ করে থাকে।
অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফাইবার ভাড়ায় অতিরিক্ত খরচ আরোপের সরাসরি প্রভাব পড়বে গ্রাহক পর্যায়ে। মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার মন্তব্য করেন, খরচ বাড়ালে পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, সরকার একদিকে ইন্টারনেট খরচ কমানোর ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে কাঠামোগত খরচ বাড়ানো হচ্ছে—এটি পরস্পরবিরোধী নীতি। তিনি যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানান।
অন্যদিকে অপারেটরদের দাবি, রেলওয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ ফাইবারই অপ্রচলিত বা অব্যবহৃত। এক দশক আগেই গ্রামীণফোন রেলওয়ের প্রায় ১,৮৬৯ কিলোমিটার ফাইবার নিজ খরচে প্রতিস্থাপন করেছিল। এখন এসব ফাইবারের একটি বড় অংশের আয়ুষ্কাল শেষের পথে। তারপরও মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য অবাঞ্ছিত চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে রেলওয়ের পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও বিটিসিএলও ফাইবার ভাড়া দিয়ে থাকে। এর মধ্যে পিজিসিবিও সম্প্রতি ভাড়া বাড়িয়েছে। ফলে সরকারি এসব সংস্থার মধ্যে এখন একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অপারেটরদের মতে, আলাদা সংস্থার ফাইবার স্থাপন ব্যয় ভিন্ন হওয়ায় মূল্য নির্ধারণেও তার প্রতিফলন থাকা উচিত।
সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ইন্টারনেটের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিল। বিভিন্ন সরবরাহ পর্যায়ে—যেমন সাবমেরিন কেবল, আইটিসি, আইআইজি এবং এনটিটিএন পর্যায়ে—১০ থেকে ২০ শতাংশ দাম কমানো হয়। মোবাইল অপারেটরদের দিক থেকেও গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য হ্রাসের আহ্বান জানানো হয়। এমনকি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটেও সর্বনিম্ন ৪০০ টাকার মাসিক প্যাকেজ চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম মনে করেন, সরকারের ঘোষিত মূল্যছাড়ের বাস্তব সুফল সাধারণ গ্রাহক পাচ্ছে না। তিনি বলেন, “সস্তা রাজনীতির নামে দাম কমানোর চাপ দেওয়া হচ্ছে, অথচ সরকার কাঠামোগত কোনো ছাড় দিচ্ছে না। এতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সত্যিকারের মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে।”
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, একদিকে খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে দাম কমানোর চাপ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের গুণমান, গতি ও স্থায়িত্ব নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। তাই খাত সংশ্লিষ্টরা চাইছেন, একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও যৌক্তিক সমাধানের দিকে এগিয়ে যাক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।