আবারও আলোচনায় এসেছেন সংগীতশিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল। এবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সাত মাস ধরে এক কলেজছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের। সোমবার রাতে ডেমরা থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, অভিযোগ পাওয়ার পর ডেমরার একটি বাসা থেকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্ভাবনার তারকা থেকে বিতর্কিত এক নাম
নোবেল এক সময় ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় সংগীতশিল্পী। ভারতের জনপ্রিয় সংগীত প্রতিযোগিতা ‘সারেগামাপা’-তে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নিয়ে তিনি রাতারাতি তারকাখ্যাতি লাভ করেন। তবে সেই জনপ্রিয়তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, মাদকাসক্তি, সহিংস আচরণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশোভন মন্তব্যের কারণে একে একে হারান ভক্তদের আস্থা ও ভালোবাসা।
একের পর এক অভিযোগ
নোবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা বেশ দীর্ঘ। ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের এক তরুণী তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন। এরপর আরও বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, ফেসবুকে কটূক্তি, মাদকাসক্ত অবস্থায় কনসার্টে উঠা, সাংবাদিককে হুমকি দেওয়াসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়।
২০২৩ সালে কুড়িগ্রামে এক কনসার্টে মদ্যপ অবস্থায় স্টেজে উঠে দর্শকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেন তিনি। উপস্থিত জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে পানির বোতল ও জুতা ছুড়ে মারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আয়োজকরা তাঁকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কেলেঙ্কারি
নোবেলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কটূক্তি ও মানহানিকর মন্তব্য করার জন্য। জাতীয় সংগীত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি শিল্পী জেমস ও গীতিকার ইথুন বাবুকেও অপমান করেছেন প্রকাশ্যে। ইথুন বাবু তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
এছাড়াও ২০২১ সালে সময় টিভির একজন বিনোদন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে নোবেলের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক আল কাছিরকে ফোন করে অপহরণের হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন টিভি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) নিন্দা জানায় এবং নোবেলকে বর্জনের হুঁশিয়ারি দেয়।
ব্যর্থ দাম্পত্য ও সম্পর্কের জটিলতা
ব্যক্তিগত জীবনেও নোবেল ছিলেন আলোচিত। প্রথম স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদের সঙ্গে বিয়ের পরপরই তাঁদের মধ্যে শুরু হয় কলহ ও গণমাধ্যমে একে অপরকে দোষারোপ। শেষমেশ তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে।
২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি খুলনার এক ফুড ব্লগার ফারজানা আরশিকে বিয়ে করেন বলে ফেসবুকে দাবি করেন। কিন্তু সেই সম্পর্কও টেকে না। বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় নোবেল মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন, আর আরশি খুলনায় ফিরে যান। পরে আরশি জানান, তিনি জানতেন না নোবেল ওই ছবি পোস্ট করবেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত বিতর্ক হবে।
সর্বশেষ গ্রেপ্তার ও অভিযোগের বিবরণ
সবশেষে ২০২৫ সালের মে মাসে এক কলেজছাত্রীকে অপহরণ, ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেলের অভিযোগে নোবেল গ্রেপ্তার হন। মেয়েটির পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ করে জানায়, গত নভেম্বরে গুলশানে দেখা করার কথা বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে যান নোবেল এবং বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ডেমরার একটি বাসায় আটকে রাখেন। এই সাত মাস তিনি মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন এবং সেই ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে ব্ল্যাকমেল করেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নোবেল সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ জন্য তিনি একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করেছিলেন, তবে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
আইনজীবীর দাবি ও পাল্টা ব্যাখ্যা
নোবেলের আইনজীবী মো. জসিমউদ্দীন দাবি করেন, ভিকটিম মূলত নোবেলের বৈধ স্ত্রী এবং তাঁরা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটি এখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পারিবারিক মনোমালিন্যের কারণে এই মামলা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। আদালতের কাছে জামিন চাওয়ার সময় আইনজীবী বলেন, আসামি সংসার করতে চান এবং আপসে মীমাংসা করতে প্রস্তুত।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মাদকাসক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার একজন মানুষের ব্যক্তিগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, পর্যাপ্ত ঘুম, পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ—এই উপাদানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
মাঈনুল আহসান নোবেল এক সময়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হলেও বর্তমানে নানা কেলেঙ্কারি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতার কারণে এক বিতর্কিত নাম হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একের পর এক ঘটনা শুধু তাঁর ক্যারিয়ার নয়, একটি প্রতিভাবান শিল্পীর পতনের চিত্র স্পষ্ট করে তুলেছে।
নিয়ন্ত্রিত জীবন ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া একজন তারকা কত দ্রুত বিতর্কের কেন্দ্রে চলে যেতে পারেন, নোবেল তার বাস্তব উদাহরণ।