নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল রংপুরের আদুরী

News Desk

নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল রংপুরের আদুরী. Dhakainlight.com

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কিশোরী আদুরী আখতার নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে শুধু নিজের জীবনই রক্ষা করেননি, বরং পুরো সমাজের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ তার বাবা বিয়ের আয়োজন করলে আদুরী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। পরিবার ও সমাজের চাপে মুখ না ঘুরিয়ে সে সরাসরি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং স্থানীয়দের কাছে অভিযোগ করে। একপর্যায়ে নির্জন একটি বাড়িতে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে আদুরী মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে স্থানীয় উন্নয়নকর্মী জেসমিন আখতারকে জানান। পরে পুলিশ ও ইউএনও গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করে দেন।

এই ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে কাজি, বর, বরের বোন ও বাড়ির মালিককে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।

সোমবার রংপুরের আরডিআরএস মিলনায়তনে ‘জননী’ প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জেলা পর্যায়ে ম্যাস মিডিয়া ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আদুরী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সে জানায়, ‘যদি বিয়ে করতাম, তাহলে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত, জীবন থেমে যেত। আমি স্বনির্ভর হতে চাই, নিজে কিছু করতে চাই।’

আদুরীর স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবেদুল ইসলাম বলেন, “পীরগঞ্জের কুমেদপুর ইউনিয়নে আদুরী যেভাবে বাল্যবিবাহ রুখেছে, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।” আদুরীর সাহসিকতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মধ্যে প্রশংসার সুর তোলে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রংপুর বিভাগে বাল্যবিবাহের হার এখনও ৬৮ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় ৫০ শতাংশ। গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও রংপুরে এই হার তুলনামূলকভাবে বেশি। গাইবান্ধায় ১৬ বছরের আগেই বিয়ের হার ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ।

পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, ১৫-২০ বছর আগে জাতীয়ভাবে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৫৯ শতাংশ, এখনো তা মাত্র ৯ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকায় এখনও বাল্যবিবাহের হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ।

বক্তারা বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে তুলে ধরেন অভিভাবকদের আর্থিক অসচ্ছলতা, মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, ঘটকদের প্রভাব, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কমিউনিটির সমন্বয়হীনতা, জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধনে অব্যবস্থা এবং আইনের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব।

প্রতিরোধে বক্তারা সুপারিশ করেন—অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটিকে সক্রিয়করণ, বিয়ের নিবন্ধন অনলাইনভিত্তিক করা, কাজিদের কার্যক্রমে নজরদারি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সামাজিক পদক্ষেপ এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও অধিকারভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. রুহুল আমিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোস্তফা মনসুর আলম খান, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সেলোয়ারা বেগম, ‘জননী’ প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল কুমার রায়, শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীরা।

‘জননী’ প্রকল্পের কারিগরি বিশেষজ্ঞ সৈয়দা জামিলা সিদ্দিকা অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকল্প ও ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কমিউনিকেশন ও ডকুমেন্টেশন বিশেষজ্ঞ জাহানারা হৃদিতা।

আদুরীর সাহসিকতা আমাদের সমাজে নতুন বার্তা দেয়—প্রতিটি কিশোরীর উচিত নিজের অধিকারের জন্য সচেতন থাকা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়ানো।

Footer Section