বাংলাদেশে অতীতের অন্যায়, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। আজ শনিবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর (দ্বিতীয় খসড়া) ওপর আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, বাংলাদেশে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা হবে।
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “ফরহাদ ভাই বারবার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের কথা বলেছেন। ট্রুথ জাস্টিস কমিশন অথবা ট্রুথ রিকনসিলিয়েশন কমিশনের খুব দরকার আছে। এটা সম্ভবত আমাদের দেশে ১৯৭২ সাল থেকেই থাকলেই ভালো হতো। আমরা সবকিছুই খুব প্রফেশনালভাবে নিষ্পত্তি করতে চাই। আমরা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করব।”
এই বক্তব্যে স্পষ্ট, সরকার দেশের অতীত নির্যাতন, নিপীড়ন ও গুমের ঘটনা নিয়ে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যের গণ্ডিতে আটকে না থেকে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে একটি কাঠামোগত উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে নির্যাতনের শিকাররা তাঁদের অভিজ্ঞতা জানান, অপরাধীরা স্বীকারোক্তি দিয়ে সত্য প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্র একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের পথ তৈরি করে। এই ধরনের কমিশন দক্ষিণ আফ্রিকা, চিলি, রুয়ান্ডা, পেরুসহ অনেক দেশে অতীতের ভয়াবহ সহিংসতা বা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের পরে শান্তি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বহু অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের অধিকাংশই আজও নিষ্পত্তিহীন। ফলে ভুক্তভোগীদের পরিবার, মানবাধিকার সংগঠন ও সচেতন নাগরিক সমাজের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি কমিশনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছিল।
আসিফ নজরুলের বক্তব্যে যে অতীতের ভুলগুলোর স্বীকৃতি আছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন দায়িত্বশীল পদে থেকে অতীতের অবিচার স্বীকার করে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্বচ্ছ ন্যায়ের ভিত্তি তৈরি করার ঘোষণা দেওয়া সত্যিই সাহসী পদক্ষেপ।
এই কমিশনের লক্ষ্য থাকবে সত্য উদঘাটন, নির্যাতনের শিকারদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা, সমাজে ক্ষমা ও পুনর্মিলনের পরিবেশ তৈরি করা এবং ভবিষ্যতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ বন্ধ করা। এক্ষেত্রে কমিশনের কার্যক্রম হবে তথ্য-প্রমাণভিত্তিক, স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং পেশাদার।
তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও থাকবে। যেমন—কমিশনের সদস্য নির্বাচন, রাজনৈতিক চাপের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা বাহিনী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা পাওয়া, সাক্ষীদের সুরক্ষা এবং কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। এসব বিষয়ে স্পষ্ট আইনি কাঠামো ছাড়া কমিশন একটি প্রতীকী উদ্যোগ হয়ে থাকার ঝুঁকিও রয়েছে।
তারপরও, এটি যদি বাস্তবায়িত হয় এবং কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি হতে পারে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। একদিকে যেমন বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটবে, অন্যদিকে সমাজে একটি নির্ভরযোগ্য বিচার ও পুনর্মিলনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের ঘোষণা কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি একটি নৈতিক দায়ও। এটি বলার সুযোগ করে দেয় যে, একটি রাষ্ট্র অতীতের ভুল স্বীকার করে, নির্যাতনের শিকারদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি মানবিক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজ গড়ে তুলতে চায়।
এখন অপেক্ষা, এই ঘোষণাটি কিভাবে আইনি কাঠামোয় রূপ পায় এবং তা বাস্তবে কতটা কার্যকরভাবে রূপায়িত হয়। তবে এতটুকু নিশ্চিত—দেশের ইতিহাসে এই বক্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী মাইলফলক হয়ে থাকবে।