ইউনূস সরকারের চেয়ে ভালো কী হতে পারত

News Desk

Updated on:

ইউনূস সরকারের চেয়ে ভালো কী হতে পারত.

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন চারদিকে ছিল চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা—প্রশাসন অচল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজকতা, জনজীবনে অনিশ্চয়তা।

৫ আগস্ট যেদিন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, সেদিন মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রথম তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের বারবার অনুরোধে তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে ঢাকা থেকে যোগাযোগের বিষয়ে বর্ণনা আছে প্রথমা প্রকাশন থেকে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সদ্য প্রকাশিত জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু বইয়ে। 

ছাত্রনেতাদের সেদিনকার চিন্তা সঠিকই ছিল। সেই অনিশ্চিত সময়ে এমন একজন ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল, যাঁর প্রতি দেশের বৃহত্তর জনগণের আস্থা আছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দলের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তারাও অধ্যাপক ইউনূস ছাড়া অন্য কারও নেতৃত্ব মেনে নিত কি না সন্দেহ। 

অতএব, সাড়ে সাত মাস পর অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা বিচার করতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক–রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে। অতীতে আমাদের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকারগুলো কী করেছে, তা–ও মনে রাখতে হবে।

বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাসের দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। এখানে দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ, শিক্ষার সুযোগ থেকে এখনো ৩০ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে ধনী–গরিবের বৈষম্যও।  

বলা প্রয়োজন, নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসে। তাদের পক্ষে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া সহজ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে তা নেওয়া সম্ভব নয়। তদুপরি ইউনূস সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। 

এ অবস্থায় সরকারের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। দ্বিতীয় কর্তব্য হয় বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ধ্বংসের কিনারে যাওয়া ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। 

অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দুটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটি হলো, টিমওয়ার্ক বা সমন্বিত কার্যক্রম। অতীতের প্রায় সব সরকারই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক—সরকারপ্রধান না বললে কিছু হতো না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা স্বাধীনভাবেই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন। দ্বিতীয়ত, এই সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক, এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোয় এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মুহাম্মদ ইউনূস যাঁদের নিয়ে সরকার গঠন করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতি ও প্রশাসনের বাইরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় তাঁদের পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বয়স, অভিজ্ঞতার কারণেও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সবার কাজের দক্ষতা একই রকম নয়। কয়েকজন নিজের মন্ত্রণালয় চালানোর বিষয়ে সক্রিয়তা দেখালেও অন্যদের এ বিষয়ে বেশ ঘাটতি আছে বলে অনেকে মনে করেন।  

মুহাম্মদ ইউনূস স্বীকার করেছেন, দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর বা তাঁর সরকারের বেশির ভাগ উপদেষ্টার নেই। কোনো মন্ত্রণালয়ে ভালো কাজ হলে তার কৃতিত্ব সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা নিতে পারেন, নিচ্ছেনও। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয় কাঙ্ক্ষিত ফল দেখাতে না পারলে সেই দায় পুরো সরকার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রধান উপদেষ্টার ওপরই পড়ে।

বিভিন্ন মহলে সমালোচনা আছে, অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না। এই সমালোচনা ভিত্তিহীন নয়। কোনো কোনো উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা পীড়াদায়কও। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা পদে মুহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প কারও কথা ভাবা যেত কি? অন্য কেউ কি বিবদমান পক্ষগুলোকে এক টেবিলে বসাতে পারতেন?

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল ও পক্ষকে এক টেবিলে বসানো। সেই কাজে তারা মোটামুটি সফল হয়েছে। বিলম্বে হলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।

Leave a Comment

Footer Section