মানুষের জীবনে কখনো এমন সময় আসে যখন সব কিছু থমকে যায়। মনে হয়, চারপাশে শুধু অন্ধকার, নিরবতা আর ব্যর্থতা। এমন সময়ে অনেকে হতাশায় ডুবে যান, কেউ কেউ আল্লাহর সাহায্য থেকেও নিরাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়—আল্লাহর দয়া কখনো শেষ হয় না, আর কোনো কষ্ট স্থায়ী নয়। এই বার্তাই আমরা পাই পবিত্র কুরআনের একটি অত্যন্ত কোমল ও অনুপ্রেরণামূলক সূরায়—সুরা আদ-দুহা।
সুরা আদ-দুহা: পটভূমি ও তাৎপর্য
সুরাটি নাজিল হয় এমন এক সময়ে, যখন মহানবী মুহাম্মদ (সা.) কিছুদিন ওহি না পেয়ে খুব চিন্তিত ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কুরাইশরা তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করছিল—“তোমার রব তো বুঝি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছেন।” তখন আল্লাহ এই সুরাটি নাজিল করেন, যাতে নবীজিকে সান্ত্বনা দেওয়া হয় এবং তাঁর ভেতর আশার আলো জাগে। এই সুরার প্রতিটি আয়াত আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রাসঙ্গিক এবং আশার উৎস।
সুরা আদ-দুহা আমাদের কী শেখায়?
১. আল্লাহ কখনো ত্যাগ করেন না
“তোমার পালনকর্তা তোমাকে ত্যাগ করেননি এবং তিনি রুষ্টও হননি।” (আয়াত ৩)
আমরা জীবনের কষ্টের সময় ভাবি, আল্লাহ বুঝি আমাদের ভুলে গেছেন। কিন্তু এই আয়াত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আল্লাহ আমাদের প্রতি সর্বদা সদয়, এমনকি যখন আমরা কাঁদি, তখনও তিনি আমাদের কান্না শোনেন।
২. আজকের কষ্ট, আগামীর সুখের প্রস্তুতি
“আর পরবর্তী জীবন তোমার জন্য প্রথম জীবনের চেয়ে উত্তম।” (আয়াত ৪)
এই আয়াত কেবল আখিরাতের কথা বলে না, বরং এটাও বোঝায় যে, প্রতিটি কঠিন সময় এক নতুন উত্তম সময়ের পূর্বাভাস। ঠিক যেমন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পরের দিন নতুন করে উদিত হয়।
৩. দয়া ও কৃতজ্ঞতার শিক্ষা
“আর তোমার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা ঘোষণা করো।” (আয়াত ১১)
কখনো আমরা কষ্টে পড়ে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতগুলো ভুলে যাই। এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—যার ভেতর কৃতজ্ঞতা আছে, তার হৃদয়ে হতাশা বাসা বাঁধতে পারে না।
ব্যক্তিগত জীবনে সুরা আদ-দুহা: আশার চাবিকাঠি
প্রত্যেক মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সুরা আদ-দুহার মতো আশার বার্তার প্রয়োজন অনুভব করে। যেমন:
- একজন এতিম শিশু—যে হয়তো বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। তার জন্য আয়াত ৬: “তিনি কি তোমাকে এতিমরূপে পাননি, অতঃপর আশ্রয় দেননি?”—এই আয়াত যেন এক মমতাময় আশ্বাস।
- একজন কর্মহীন যুবক—যে হয়তো অভাবগ্রস্ত। আল্লাহ বলেন, “আর তিনি তোমাকে অভাবগ্রস্ত পেয়েছিলেন, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন।” (আয়াত ৮)
- একজন পথহারা আত্মা—যে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছে না। আয়াত ৭ বলে, “তিনি তোমাকে পথভ্রষ্ট পেয়েছিলেন, অতঃপর পথ দেখিয়েছেন।” এ আয়াত তাকে জানিয়ে দেয়—আল্লাহর দিকে ফিরলেই সে সঠিক পথ পাবে।
হতাশার দুনিয়ায় সুরা আদ-দুহা এক আলো
বর্তমানে হতাশা, মানসিক চাপ, আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জীবন নিয়ে বিভ্রান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায়। ঠিক এমন সময় এই সূরা হতে পারে একটি মানসিক শক্তির উৎস।
ধর্ম শুধু নামাজ, রোজা নয়—বরং আত্মিক প্রশান্তির একটি উৎস। কুরআনের এই সূরাটি যেন এক থেরাপি—“ইসলামিক থেরাপি ফর হোপ”। যারা বিষণ্নতায় ভোগেন, তারা প্রতিদিন এই সূরাটি পাঠ করলে হৃদয়ের ভেতর আশার আলো জ্বলতে শুরু করে।
আমাদের কর্তব্য: এই আলো অন্যদের পৌঁছে দেওয়া
এই সূরার শেষ তিন আয়াতে (৯-১১) আমাদের কাজের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে:
১. এতিমের প্রতি কঠোর হবে না।
→ সমাজে এতিম, অসহায়, অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানো।
২. প্রার্থীকে ধমক দেবে না।
→ যারা সাহায্য চায়, তাদের সম্মানের সাথে দেখা।
৩. আল্লাহর নেয়ামতের কথা প্রচার করো।
→ আমাদের প্রাপ্তি ও নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ থাকা এবং তা অন্যদের জানানো।
এগুলো শুধু আদর্শ নয়—একটি পরিপূর্ণ জীবন যাপনের মূলনীতি।
উপসংহার:
সুরা আদ-দুহা শুধুমাত্র একটি সুরা নয়, এটি একটি বেঁচে থাকার বার্তা। এটি বলে—আলো আসবেই, শুধু ধৈর্য ধরো। এটি নবীজিকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, আমাদেরও দেয়। যখন তুমি ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, অবহেলিত বা পরাজিত মনে করো—এই সূরাটি পড়ো। বারবার পড়ো। কেঁদে পড়ো আল্লাহর দরবারে।
আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কখনো ছেড়ে দেন না। তুমি যদি তাঁকে স্মরণ করো, তিনি তোমার হাত ধরবেন। আর সেই হাত ধরা মানেই—আলো ফিরে আসা।
শেষ কথাঃ
“আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সুরা যুমার ৫৩)
এই একটি বাক্যই যেন সুরা আদ-দুহার সারকথা।
তথ্যসংগ্রহ ও উপস্থাপনায়: তারেক আজিজ মোল্লা।