ভারতের ‘বিশ্ব কারখানা’ হয়ে ওঠার স্বপ্ন নতুন নয়। তবে সেই স্বপ্ন যখন বাস্তব রূপ নেওয়ার দিকে এগোচ্ছিল, তখনই ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক সমঝোতার ইঙ্গিত ভারতের সম্ভাবনাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি চীনা পণ্যের ওপর বিশাল শুল্ক হ্রাস করেছেন। আগে যেখানে শুল্কহার ছিল ১৪৫ শতাংশ, তা কমিয়ে ৩০ শতাংশে আনা হয়েছে। অপরদিকে ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ২৭ শতাংশ। ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত চীন থেকে ভারতে উৎপাদন স্থানান্তরের আশা ম্লান করে দিয়েছে।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, ওয়াশিংটন-বেইজিং চুক্তির ফলে চীন থেকে ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাব্য অনেক উৎপাদন উদ্যোগ থমকে যাবে বা আবার চীনে ফিরে যাবে। তার মতে, ভারতের সস্তা উৎপাদন ব্যয় টিকে থাকলেও পণ্যের মান উন্নয়নের সম্ভাবনা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
মাত্র এক মাস আগেই মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপল তাদের আইফোন তৈরির বড় অংশ চীন থেকে ভারতে আনার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছিল। এতে দিল্লিতে ব্যাপক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে সেই আশার জায়গায় এখন দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে।
যদিও এখনো অ্যাপল চূড়ান্ত কোনো ঘোষণা দেয়নি, তবে তাদের আইফোন কারখানা ভারতে সরানোর সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচও হয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেনি।
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর আগেও অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুককে ভারতে কারখানা না গড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ভারত উচ্চ শুল্ক আরোপকারী দেশগুলোর একটি।
এই প্রসঙ্গে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ শিলান শাহের মন্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের সরবরাহে চীনের বিকল্প হিসেবে ভারত ভালো সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। যদিও তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন ওয়াশিংটন-বেইজিং চুক্তির আগে।
শাহ আরও বলেন, ভারতের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ৪০ শতাংশ চীনের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে চীনের শুল্কজনিত ঘাটতি ভারতের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ ছিল।
সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, ভারতে নতুন রপ্তানি আদেশ ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে বোঝা যায়, ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা চীনের জায়গা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
কিন্তু এখন ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক পুনর্গঠনের ঘোষণা সেই স্বপ্নে বড় ধাক্কা দিতে পারে। যদিও অনেক বিশ্লেষক এখনো আশাবাদী। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত দূরত্ব এখনো রয়ে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে।
ভারতও একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে। এ ছাড়া চীন ত্যাগের যে বৈশ্বিক প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা ভারতের মতো এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখতে পারে। কারণ অনেক বৈশ্বিক কোম্পানি এখন তাদের সরবরাহব্যবস্থা বৈচিত্র্যময় করতে উদ্যোগী হয়েছে।
তবে ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা ও অরুদিপ নন্দীর মতে, শুধু চীন নয়—ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোকেও প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই দুই গবেষক বলেন, ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে ভারতকে বাস্তবমুখী এবং কার্যকর সংস্কার করতে হবে। শুধু শুল্ক সুবিধার ওপর ভর করে এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা যাবে না।
ফলে, অ্যাপলের কারখানা চীন থেকে ভারতে সরবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো অনিশ্চিত। তবে বিষয়টি ভারতের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নয়, বৈশ্বিক অবস্থান নির্ধারণের বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।